৭ থেকে ৮ বছরের ব্যবধানে অপ্রচলিত ফল লটকন নরসিংদীর অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন। নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার গ্রামগুলোর ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে ছায়াঘেরা লটকন বাগান। বাগানের অধিকাংশ গাছ গোড়ালি থেকে উপরি অংশের শাখা-প্রশাখায় লটকন ফলে জড়িয়ে আছে। লটকন চাষ করে এ জেলার চাষিরা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সৌন্দর্য ও স্বাদে সুমিষ্ট হওয়ায় দেশবাসীর পাশাপাশি বিদেশেও এর কদর বাড়ছে। ভালোমানের লটকন মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপে রফতানি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, নরসিংদীর শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল রঙের উঁচু মাটিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান থাকায় এ এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য খুব উপযোগী। গেল বছর এ জেলায় ৫৩৯ হেক্টর জমিতে লটকনের চাষ হয়েছিল। চলতি বছর তা বেড়ে ৫৮০ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিক চাষ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ঘরবাড়ি এবং পতিত জমিতেও লটকন গাছ রয়েছে, যা কৃষি বিভাগের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত নয়। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর লটকন উৎপাদনের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নরসিংদীর শিবপুর আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম আরিফুল হক বলেন, লটকনে প্রচুর ভিটামিন ‘বি-২’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আমিষ, স্নেহ, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান। প্রতিদিন দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ প্রয়োজন, চারটি লটকনই তা মেটাতে যথেষ্ট।
লটকন চাষি শিবপুরের জয়নগর আলহাজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ললিত রায় বলেন, ১২ থেকে ১৪ বছর আগে গ্রামের লোকজন শখের বশে বাড়ির আঙিনায় লটকন গাছ লাগাতেন। দেখতে সুন্দর ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়ে। সেইসঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভজনক ফলন হিসেবে লটকনের চাষের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। লটকন চাষি রাকিবুল হাসান বলেন, সাধারণত একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ৭ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া মৌসুমি ফসলের মধ্যে শুধু সৌন্দর্য ও স্বাদে নয়, লটকন নিরাপদও বটে। কারণ লটকন বাজারজাতে ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান থেকে কিনে নেন। পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। মৌসুমি ব্যবসায়ী আবদুল হক বলেন, ৫ বছর ধরে তারা চারজন মিলে লটকনের বাগান কিনে ব্যবসা করছেন। এবারও ৪ লাখ টাকায় তিনটি বাগান কিনেছেন। এতে ২ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরা উপজেলার মরজাল বাজারে গড়ে উঠেছে লটকনের হাট। সকাল থেকে আশপাশের গ্রামের চাষিরা ঝুড়িতে লটকন নিয়ে হাটে আসছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে লটকন কিনে ট্রাকে ভর্তি করছেন। বাজারে কথা হয় শিবপুর উপজেলার ছোটাবন গ্রাম থেকে লটকন নিয়ে আসা আবদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, দেশ-বিদেশে কদর বাড়ার কারণে এবার হাটে লটকনের চাহিদা বেশ। প্রকার ভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে, যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি ৪ কানি জমির লটকন বাগান থেকে খরচ বাদ দিয়ে ২ লাখ টাকা মুনাফার আশা করছেন। নরসিংদী থেকে ঢাকার শ্যামবাজারে পাইকারি লটকন বিক্রি করেন আলতাফ হোসেন। তিনি জানান, নরসিংদীর লটকন দেখতে বড় ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ঢাকার বাজারে এর চাহিদা ব্যাপক। প্রতিদিন এ বাজার থেকে তিনি ৩০ থেকে ৪০ মণ লটকন কিনছেন। জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু হওয়া এ লটকনের বাজার চলবে পুরো জুলাই মাস।