ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নপূরণে এলো শিশুশ্রমিকের ব্যাংক হিসাব

মরিয়ম সেঁজুতি : শরিফ, পরিচয় বলতে শিশুশ্রমিক। নির্মম পরিহাসের শিকার এ শিশুটির ভাগ্য অনেকটা বদলে দিয়েছে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব। শৈশবেই বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শরিফ একটি বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পায়। তবে তার ভাগ্য বদলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পদক্ষেপ। মাত্র ১০ টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক পথশিশুদের যে ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তারই গর্বিত সদস্য শরিফ হোসেন। এক এক করে শরিফ তার ১০ টাকার ব্যাংক হিসাবে জমা করেছে সাড়ে ৭ হাজার টাকার ওপরে। তাকে কোনো প্রকার চার্জ দিতে হয় না। উপরন্তু নিয়মিত মেলে মুনাফা। এই হিসাবের বিপরীতে চাইলে ব্যবসা করার জন্য সে ভবিষ্যতে জামানতবিহীন ঋণও পাবে। এই ব্যাংক হিসাব দিয়েই ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখছে শরিফ। শরিফের মতো এমন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা অন্তত সাড়ে ৪ হাজার। তবে আরো বড় অবাক করা বিষয় হলো এমন শিশুশ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে রয়েছে অন্তত ৩০ লাখ টাকা। ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার বিষয়ে শরিফ জানায়, প্রথম যখন সে ব্যাংক হিসাব খোলে, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক তার ঈদের খরচ হিসেবে ১ হাজার টাকা দেয়। শুধু তাই নয়, গত শীতে ১০ টাকার হিসাবধারী প্রত্যেককেই শীতের পোশাক দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানীর বস্তি, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও ফুটপাতের শিশুশ্রমিকদের আর্থিক সেবার আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয় এমন কার্যক্রম। মাত্র ১০ টাকা দিয়ে ১১টি এনজিওর সহযোগিতায় এসব শিশুশ্রমিক একাউন্ট খুলে। ১৬টি ব্যাংকে তাদের হিসাব খোলা হয়। এসব একাউন্ট থেকে কোনো ধরনের চার্জ গ্রহণ করবে না ব্যাংক। তবে শিশুশ্রমিকদের আমানতে সর্বোচ্চ সুদ প্রদান করা হবে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই ব্যাংক হিসাব তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও বিপথে যাওয়া রোধ করবে। আর পথশিশুদের জমার ওপর সর্বোচ্চ সুদ দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তাদের বয়স ১৮ বছর হলে তাদের ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে দিতে হবে।

মাত্র ১৩ বছর বয়সী রাজু। কাজ করে সূর্যোদয়ের আগ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তাও আবার ঝুঁকিপূর্ণ ‘লেগুনা’ পরিবহনের হেলপার হিসেবে। আলাপচারিতা থেকে জানা যায়, রাজু রাজধানীর গুলিস্তান থেকে গোড়ান রুটে লেগুনা পরিবহনের হেলপার। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ

হয়েছিল রাজুর। পারিবারিক টানাপড়েনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়ার আর সুযোগ হয়নি। বাবা শাহজাহান একজন ভাসমান ব্যবসায়ী। রাজুকে লেখাপড়া করাতে অনীহা বাবার। তাই নিজ দায়িত্বেই এই কাজটি জোগাড় করেছে রাজু। বাসাভাড়া ও খাবারের টাকা জোগাড় করতে মা-বাবাকে সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি ব্যাংকে ১০ টাকার হিসাব খুলেছে। তার ইচ্ছে আরেকটু বড় হয়ে ব্যবসা শুরু করবে। তখন আর তাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হবে না। মা-বাবাকেও কষ্ট করতে হবে না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশুশ্রম জরিপে দেখা গেছে, দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী এ শিশুরা পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সব মিলিয়ে দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। শিশুশ্রম জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে সব মিলিয়ে শ্রমে নিয়োজিত ২৪ লাখ ৭০ হাজার শিশু রয়েছে গ্রামাঞ্চলে। শহরে এই সংখ্যা ৫ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার। ২১ লাখ ছেলেশিশু শ্রম দিচ্ছে, অন্যদিকে মেয়েদের সংখ্যা হলো সাড়ে ১৩ লাখ। কর্মে নিয়োজিত শিশুদের ৩১ ভাগ স্কুলে যাচ্ছে। পরিবারে সহযোগিতার ফলে এক-তৃতীয়াংশ শিশু কখনোই স্কুলে যেতে পারছে না। এর বাইরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশুর পরিবার পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে পারছে না।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিনে গড়ে একটি শিশু সাড়ে ৬ ঘণ্টা কাজ করছে। মাসে আয় করছে মাত্র ৫ হাজার ৯শ টাকা। সিটি কর্পোরেশনে তাদের আয় বেশি- গড়ে ৭ হাজার ১শ টাকা। গ্রামীণ এলাকায় গড়ে আয় করছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। শিশুদের এই কষ্টোপার্জিত অর্থের সুরক্ষা দিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে হাতে নেয়া হয় ব্যাংক হিসাব খোলার কার্যক্রম। রাজধানীর বস্তি, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও ফুটপাতে বসবাসরত কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের ব্যাংকিং খাতে আনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা তৈরি, কষ্টোপার্জিত অর্থের সুরক্ষা, পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করাসহ তাদের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য এসব শিশুশ্রমিকের ভবিষ্যতে উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে তাদের নামে ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেনের’ নেতৃত্বে আটটি এনজিও এবং ১০টি ব্যাংক পথশিশু ও কর্মজীবী কিশোরদের ব্যাংক হিসাব খোলার দায়িত্ব নেয়। পরে আরো তিনটি এনজিও এবং ৬টি ব্যাংককে যুক্ত করা হয়। যেসব ব্যাংক তাদের হিসাব খুলেছে সেগুলো হলো রাষ্ট্রায়ত্ত- সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক- এশিয়া ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকে শিশুরা সবচেয়ে বেশি একাউন্ট খুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিশুশ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরিদ উদ্দিন বলেন, পথশিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এ ধরনের সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়েছে। আমরা শুরু থেকেই এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলাম। রূপালী ব্যাংক পথশিশুদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছে, যেন এসব শিশু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টাকা জমিয়ে ভবিষ্যতে কোনো কাজে লাগাতে পারে। তাদের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে।

যেসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) শিশুদের নিয়ে কাজ করে, বিশেষ করে শিশুশিক্ষা, শিশুশ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও শিশুদের উপযোগী ব্যবসায় যেসব এনজিও প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা দিয়ে থাকে, সেসব এনজিও শিশুর একাউন্ট খুলতে সহযোগিতা করেছে। এনজিওগুলো এসব শিশুর সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান ও ব্যাংক সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। উদ্দীপন, মাসাস, সাফ, ব্র্যাক, অপরাজেয় বাংলাদেশ, এএসডি, সিপিডি, প্রদীপন, সাজিদা ফাউন্ডেশন, নারী মৈত্রী ও পরিবর্তন শিশুদের একাউন্ট খুলতে সহযোগিতা দিয়েছে। পথশিশুদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়, ছোট্ট ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত আয় ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাত থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা সঞ্চয় করার মধ্য সঞ্চয়ী মনোভাব গড়তে বাংলাদেশ ব্যাংক সে সময় এ উদ্যোগ নেয়। যাতে সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর বলেছিলেন, এসব শিশু সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে একদিকে সঞ্চয় করতে শিখবে, অপব্যয় বন্ধ করবে এবং পুঁজি গঠনে ভূমিকা রাখবে।

নারী মৈত্রীর শিশু অধিকারবিষয়ক প্রকল্প প্রধান সমাজকর্মী রিঙ্কু রানী মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আমরাও সে সময় একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। কারণ শ্রমজীবী এসব শিশুর বয়স ৯ থেকে ১৪ বছর। এরা গড়ে প্রতিদিন অনেক টাকা আয় করে। অথচ সঞ্চয় না করে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যয় করে। ওদেরকে সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই মূলত এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব শ্রমজীবী শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিজেরাই ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে। অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, শিশুশ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবের এই উদ্যোগের সঙ্গে আমি শুরু থেকেই ছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সে সময়ের গভর্নরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই পথশিশুদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসার এমন কোনো প্রমাণ নেই। শিশুশ্রমিকদের স্বাবলম্বী করা এবং তাদের মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সে সময় এসব শিশুদের ব্যাংকের আওতায় আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, শিশুরা মাদকাসক্ত হয়ে দেশ ও সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তারা যাতে দেশের সমস্যা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে এ লক্ষ্যেই তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে এ কার্যক্রম চললেও ভবিষ্যতে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ কার্যক্রমের বিস্তার ঘটানো হবে।