স্বপ্নের মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ শুরু

এমআরটি ও বিআরটি প্রকল্পের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী

পদ্মা সেতুর পর এবার শুরু হলো স্বপ্নের মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা কীভাবে আরও উন্নত, কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এটা ঠিক যে ঢাকায় অতিরিক্ত মানুষের বসবাস। কিন্তু যে পরিমাণ রাস্তাঘাট থাকার কথা, সে পরিমাণ রাস্তাঘাটের অভাব। অন্যদিকে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হওয়ায় গাড়ি কেনার ক্ষমতাও বাড়ছে। তাই আমাদের সরকার সব সময় মনে করে, উন্নয়ন টেকসই হওয়া উচিত। তাই ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার জায়গা। এদিক থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবলআরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের আওতায় গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণকাজেরও উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক বক্তব্য রাখেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যসহ সরকারি, সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুইচ চেপে মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন। পরে এক বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন তিনি।উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মহানগরীর চারিদিকে বৃত্তাকারে সড়ক, রেল ও নৌপথ নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সারাদেশে ‘শক্তিশালী সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গ, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ (রংপুর) এবং ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। গত সাত বছরে তার সরকারের সময় ১৪টি বড় সেতুসহ ৫ হাজার মাঝারি ও ছোট সেতু হয়েছে। নতুন সড়ক নির্মিত হয়েছে ২১ হাজার কিলোমিটার। সড়ক, সেতু, নৌপথ, রেলপথ ও আকাশপথ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়নের কর্মসূচি আমরা হাতে নিয়েছি।শেখ হাসিনা বলেন, গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) রুট চালু হলে টঙ্গী ও উত্তরার সঙ্গে ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত সহজতর হবে। এর মধ্য দিয়ে দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে যাত্রী পারাপারের পাশাপাশি আরামদায়ক সেবা নিশ্চিত করা যাবে এবং রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করাও অনেকাংশে সহজ হবে বলেও প্রত্যাশা করছে সরকার। বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পারাপার সম্ভব হবে। বিআরটি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। সরকারের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাসিলিটি ফান্ড এতে অর্থায়ন করছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিআরটি চালু করা সম্ভব হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে।প্রকল্প সূত্র জানায়, মেট্রোরেল নির্মাণ শেষ হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। প্রতিটি স্টেশনে ১ মিনিট করে থামবে মেট্রোরেল। এই সময়ের মধ্যে যাত্রী ওঠা-নামা করতে হবে। স্টেশনে পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গে মেট্রোরেলের গেট খোলা হবে। প্রতি ৩ মিনিট পরপর মেট্রোরেল যাত্রা শুরু করবে। ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পের আওতায় উত্তরা তৃতীয় পর্যায় থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেলের নির্মাণ করা হচ্ছে। এই অংশের পুরোটাই সম্পূর্ণ এলিভেটেড (উড়াল পথে) তৈরি করা হবে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ কাজে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকা দিচ্ছে ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০ কিলোমিটার এই পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। প্রতি ঘণ্টায় উভয়দিকে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে ৮টি প্যাকেজে। এর মধ্যে প্যাকেজ-১’র আওতায় নির্মাণ করা হবে মেট্রোরেল ডিপো। রাজধানীর উত্তরা তৃতীয় পর্বে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণের জন্য জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের গত ২৭ মার্চ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। এছাড়া ডিপোতে ইয়ার্ড ও ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হবে প্যাকেজ-২। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন ও স্টেশন নির্মাণ করতে আলাদা প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হবে। এর মধ্যে উত্তরা ডিপো থেকে পল্লবী পর্যন্ত প্যাকেজ-৩, পল্লবী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্যাকেজ-৪, আগারগাঁও থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত প্যাকেজ-৫ ও কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইন ও স্টেশন নির্মাণে প্যাকেজ-৬। মেট্রোরেল ও স্টেশন পরিচালনায় চলন্ত সিঁড়ি ও লিফটসহ ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম ক্রয় করে আলাদা দরপত্র দেয়া হবে প্যাকেজ-৭। সর্বশেষ ১৪৪টি কোচ ক্রয় করা হবে প্যাকেজ-৮। ১৪৪টি কোচ থেকে ৬টি করে ২৪টি ট্রেন তৈরি করা হবে। এই ট্রেন চলাচল করবে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ দিয়ে। ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের ৮ প্যাকেজের মধ্যে একটি প্যাকেজ-১ দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়ে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। বাকি ৭-প্যাকেজ পর্যায়ক্রমে আলাদা দরপত্র আহ্বান করা হবে। প্যাকেজ-১ এর আওতায় গতকাল বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল ডিপো নির্মাণে কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শুরু হলো বলে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।রাজধানীর যানজট নিরসনে নির্মাণ করা হবে পাঁচটি মেট্রোরেল বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি)। এর মধ্যে রাজধানী উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি-৬ নামে আশুলিয়া-কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর দিয়ে কমলাপুর হয়ে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত এমআরটি-১ নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি আশুলিয়া-সাভার-গাবতলী-ঢাবি-ডিএসসিসি-কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি-২, কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এমআরটি-৪ এবং গাবতলী-মিরপুর-গুলশান-ভাটারা পর্যন্ত এমআরটি-৫ নামে একটি রিং মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হবে। এই ৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে ৩টি মেট্রোরেল দ্রুত নির্মাণ করতে হবে বলে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়।২০২০ সালের মধ্যে মতিঝিল (বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন) পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হলেও প্রথম পর্যায়ে ২০১৯ সালের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত বাণিজ্যিক চলাচল শুরু করা হবে। প্রথম পর্যায়ের ওই কাজ আরও একটু এগিয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে সাধারণ মানুষের জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত আরও একটু সহজ হবে। মেট্রোরেল রুট-৬ এর পাশাপাশি আরও দুটি রুট নির্মাণের প্রস্তুতি শুরুর কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।এমআরটি-১ গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে বিদ্যমান রেলপথ ধরে কমলাপুর হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত যাবে। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশ ২০২৫ সালে ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত ২০৩৫ সাল নাগাদ নির্মাণ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ের দৈর্ঘ্য হবে ২৬ দশমক ৬ কিলোমিটার, যার ৬ কিলেমিটার হবে মাটির নিচে ও বাকি অংশ উড়ালপথে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের দৈর্ঘ্য হবে ৫২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ৭ কিলোমিটার উড়ালপথে ও ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে নির্মাণ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ের জন্য ব্যয় হবে ২৮৩ কোটি ডলার ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫৮৭ কোটি ডলার।এমআরটি-২ এর সম্ভাব্য রুট ধরা হয়েছে আশুলিয়া থেকে শুরু করে সাভার, গাবতলী হয়ে মিরপুর রোড দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনের (নগর ভবন) সামনে দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত। পুরোটাই উড়ালপথে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে ৪০ কিলোমিটার ও ব্যয় ৩৭৫ কোটি ডলার। এমআরটি-৪ নির্মাণ করতে হবে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। উড়ালপথে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৪ কোটি ডলার। এমআরটি-৫টি হবে অনেকটা রিং মেট্রোরেল। এটি নির্মাণ করতে হবে ভুলতা থেকে বাড্ডা, মিরপুর সড়ক, মিরপুর-১০, গাবতলী বাস টার্মিনাল, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা সিটি (পান্থপথ) হয়ে হাতিরঝিল লিঙ্ক রোড পর্যন্ত। এটি মূলত এমআরটি-১, ২, ৪ ও ৬কে যুক্ত করবে। ৩৫ কিলোমিটার এ মেট্রোরেলটি ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে ও ২৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার উড়ালপথে নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪২৮ কোটি ডলার।বিআরটি : অনুষ্ঠানে গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করা হয়। সাড়ে ২০ কিলোমিটার দৈঘ্র্যের বিআরটি রুটে থাকবে ২৫টি স্টেশন। নির্মাণ করা হবে ছয়টি ফ্লাইওভার। এর মধ্যে উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড বিআরটি লেন থাকবে। বাকি ১৬ কিলোমিটার থাকবে সমতলে। ১৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে। বাস ভাড়া আদায় হবে ইলেক্ট্রনিক স্মার্ট কার্ডে। তিন মিনিট পরপর স্টেশন থেকে বাস ছাড়বে।এ সময় প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে মোটর ভেহিকেল চুক্তি সাক্ষর এবং বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মায়ানমারের (বিসিআইএম) মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোরের চুক্তি সাক্ষরের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পের উদ্বোধন বিষয়ে ‘ঈদের আগেই সুখবর’ পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কও চার লেন করা হবে। তাই ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। ঢাকার যানজট নিরসন ও আধুনিক নগর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই দুটি প্রকল্পের উদ্দেশ্য বলে জানান তিনি।