প্রতিবন্ধকতা জয় করলেন ফরিদগঞ্জের পল্লবী

মেয়ের জন্মের পরই মা আঁতকে উঠেছিলেন। তার মেয়ের বাম হাতের কব্জি নেই। তাই বলে মেয়েকে অনাদর করেননি মা। বরং আদর-যত্নে বড় করে তুলেন। মেয়ের নাম রাখেন পল্লবী। পল্লবী একটু একটু করে বড় হতে থাকে। স্কুলে ভর্তি হয়। ততদিনে তিনি বুঝতে পারেন, যারা তার খেলার সঙ্গী, সহপাঠী, এমনকি প্রতিবেশী তারা তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে। আশপাশের মানুষের এই দৃষ্টির কারণে ছেলেবেলা থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। বেশিরভাগ সময় নিজেকে এভাবে আড়াল করে রাখতে তার খুব অসহায় মনে হতো। কিন্তু এই অসহায়ত্বকেই শক্তিতে রূপান্তর করেন তিনি।

এরই ফলস্বরূপ শারীরিক প্রতিবন্ধী পল্লবী কর্মকার শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় ২০১৫ সালের ফরিদগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ের পর চাঁদপুর জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হন। গত ১৯ নভেম্বর জেলা পর্যায়ে ‘শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পান তিনি।

পল্লবী কর্মকার বর্তমানে ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১১৪নং কালীরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফরিদগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার ভাটিয়ালপুরের মেয়ে পল্লবীর বাবা প্রাণকৃষ্ণ কর্মকার মারা গেছেন অনেক আগে। মা লক্ষ্মী রানী কর্মকার স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ে চাকরি করেই মেয়েকে লেখাপড়া শেখান।

পল্লবীর মতে, পরিবারের সবার সহযোগিতা ও উৎসাহে পড়াশোনা করি। গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বউদ্যোগ কর্মসূচি (পিএসআইডি) নামে একটি প্রকল্প ফরিদগঞ্জ উপজেলায় আরম্ভ করি। যা বর্তমানে চাঁদপুর ডিজাঅ্যাবল্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন টু ডেভেলপমেন্ট (চাঁদপুর-ডিপিওডি) নামে পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আমার মা যোগাযোগ করেন। এই সংস্থার সমন্বয়কারী মমতাজ উদ্দিন মিলন আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আমাকে উৎসাহ দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে সহযোগিতা করেন। পল্লবী কর্মকার ফরিদগঞ্জ এ আর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি, চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে অনার্স পাস করে মাষ্টার্স ভর্তি হন।

এ প্রসঙ্গে পল্লবী বলেন, আমার এই পথচলা অতটা সহজ ছিল না। অনেক পারিপার্শ্বিক সমস্যার মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছি। অনেক সময় মাসহ পরিবারের অন্য সদস্য, সমাজের মানুষরা বলত আর পড়ার দরকার নেই। একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেও। ২০০৯ সালে বাবা মারা যাওয়ায় আবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। নিজের চেষ্টা, চাঁদপুর-ডিপিওডি-এর পরিচালকের উৎসাহ এবং আমার মায়ের উৎসাহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় চাকরির আবেদন করি। যথারীতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হই। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১০ সালে নিয়োগপত্র পাই। ১১৪নং কালীরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি।