অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিতে সরকারি পরিকল্পনা

আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিতে চায় সরকার। ইতোমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে দুই বছরের সরকারের বিভিন্ন খাতে অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাগুলোও। এর মধ্যে আছে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, ব্যয় প্রস্তাব ও অগ্রাধিকার এবং অর্থনীতির গতিধারা নিয়ে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়গুলো। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই সব কিছু করা হয়েছে।

জানা গেছে, দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সম্পদ সঞ্চালনের পাশাপাশি বর্ধিত হারে রাজস্ব আহরণ এবং সহজ শর্তে বৈদেশিক সহায়তার জন্য বিশ্বের দরবারে প্রচারের উদ্যোগ থাকছে। এ ছাড়াও ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে চায় সরকার। একই সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প যাতে সময়মতো শেষ হয় সেদিকে নজর দেওয়া হবে। এ সময়ে সরকারের চ্যালেঞ্জের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, ব্যয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণ, শ্রম মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বর্তমান সরকারকে ‘উন্নয়নের বিশ্ব মডেল’ হিসেবে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। জানা গেছে, এই উন্নয়ন উদ্যোগের অংশ হিসাবে ৩ বছরের অগ্রিম প্রক্ষেপণ করেছেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী আগামী তিন বছরের মধ্যে বাজেটের আকার হবে ৫ লাখ কোটি টাকা। এ সময়ে নতুন করে আরও ১ কোটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে বেকারত্ব কমানো, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, নানা ধরনের সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। এটি বড় অর্জন। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকেই বাজেট করা হয়েছে। বাজেটের মূল সমস্যা অর্থায়ন। আরেকটি সমস্যা রয়েছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষতার। এর ফলে সরকারের আগামী তিন বছরের যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।

সরকার বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে মধ্যমেয়াদি নীতিকৌশল নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যাতে বিনিয়োগ করতে পারে সে লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৪ শতাংশ আসে ব্যক্তি খাত থেকে। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সাফল্যের মধ্যেও বেসরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত গতি ফিরে পায়নি। মধ্যমেয়াদে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির ২৫ শতাংশ। এ লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যুতের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করা হবে। বিশেষ প্রচেষ্টা থাকবে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায়। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঝুঁকিমুক্ত ঋণ প্রদান, তহবিলে নিশ্চয়তার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠন, অনলাইন ব্যাংকিং সেবা বৃদ্ধি, খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণে তদারকি, ব্যাসেল থ্রি বাস্তবায়ন, ন্যাশনাল সুইচের আওতায় কার্ডভিত্তিক লেনদেন চালু করা হবে।

অন্যদিকে প্রতিবছরই সরকারি ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা হবে আগামী ৩ বছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি ব্যয় জিডিপির ১৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সেখানে গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ডিজিটাইজেশন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চত করার ব্যবস্থা থাকবে।

আগামী তিন বছরের মধ্যে সরকার সম্প্রসারণশীল রাজস্ব নীতি ও বর্ধিত রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা নিয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার জিডিপির ১৮ শতাংশে নেওয়া হবে। সেজন্য রাজস্ব আহরণের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ২০১৭ সলের ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। এ ছাড়া শুল্ক আইন ২০১৫ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ কর আইনটি সংশোধনে প্রক্রিয়া চলছে। কর প্রশাসনে আইন সংস্কার ও অবকাঠামোর আধুনিকায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো হবে।

আগামী তিন অর্থবছরের জন্য ইতোমধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য এ হার প্রস্তাব করা হয় ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির প্রক্ষেপণও করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, আর আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ঘোষণা করেছেন আবদুল মুহিত। সরকারি ব্যয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির ১৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বাজেট ঘাটতিও ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ শতাংশের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বৈদেশিক অর্থায়ন দেড় শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বৈদেশিক অর্থায়ন ১ দশমিক ৫ শতাংশের প্রক্ষেপণ করা হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। মুদ্রা সরবরাহ রাখা হবে ব্যাপক। ১৫ দশমিক ৭ শতাংশে নেওয়া হবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। আর বেসরকারি ঋণপ্রবাহ ১৫ শতাংশে নেওয়া হবে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ নেওয়া হবে। আগামী অর্থবছরে ১০ শতাংশ ধরা হয়েছে। আমদানি ১২ শতাংশে নেওয়া হবে। বর্তমানে ৯ শতাংশে রয়েছে। আগামী অর্থবছরে প্রাক্কলন করা হয় ১১ শতাংশ। প্রবাসী অয়েল প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের। আগামী অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ। জিডিপির আকার (চলতি মূল্যে) ২৫ হাজার ১৯৮ বিলিয়ন টাকা উন্নীত করার পরিকল্পনা সরকারের। আগামী অর্থবছরের জিপিডির আকার প্রাক্কলন করা হয় ১৯ হাজার ৬১০ বিলিয়ন টাকা।