প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাপানে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে বাংলাদেশ এক নতুন উচ্চতায় উঠে এসেছে এবং বয়ে এনেছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন বার্তা। এই সম্মেলনের মধ্যমণি ছিল বাংলাদেশ। আউটরিচ প্রোগ্রামের প্রথম অধিবেশনে স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং অবকাঠামো বিনির্মাণে সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট চারটি মৌলিক বিষয়ে আলোচনায় নেতৃত্বশীল ভূমিকা রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব অর্থনীতির সাত পরাশক্তির জোট জি-সেভেনের সম্মেলনের পরদিন ওই আউটরিচ মিটিংয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশ পৌঁছতে পেরেছে। ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি সমূহ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার বিবরণ তুলে ধরতে সক্ষম হন। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন-এ যুক্ত হওয়ার। তাই জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলেও এখান থেকে নতুন এক বাংলাদেশের পথচলা শুরু হলো।
বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে জাপানি বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জাপানিরা ব্যবসায় কতগুলো নীতি আদর্শ, প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, শ্রমের মর্যাদা, সার্বিক নিরাপত্তা, সময় জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে মান রক্ষা করে চলে। জাপানি বিনিয়োগ যেখানে গেছে, সেখানে পুরো দেশটিই অগ্রগতি লাভ করেছে। জেট্রো জরিপে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসকল প্রতিবন্ধকতার বিষয় আলোচনা করেছে সেগুলোর ভিত্তিতেই চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দুর্বল অবকাঠামো, জ্বালানির স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যানজট, আইনি জটিলতা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, নিরাপত্তা, দুর্নীতি, উচ্চ সুদ হার, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, কম মূল্যে নিম্নমানের পণ্য কেনার প্রবণতা, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। আরো রয়েছে শিল্প স্থাপনের জন্য জমি নিবন্ধন বিষয়ে ঝামেলা এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (শিল্প পার্ক), জমি স্বল্পতা প্রভৃতি যা বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত।
যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত বিনিয়োগ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ এর অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল দেশীয় বিনিয়োগ। তাই উপযুক্ত প্রণোদনা দ্বারা দেশীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। আর বিনিয়োগ নির্ভর করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। বিদেশি বিনিয়োগকারী তখনই আসবে, যখন তারা দেখবে দেশের অভ্যন্তরে দেশি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত রয়েছে। দেশি বিনিয়োগ অপ্রতুল হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা দুরূহ হবে। কারণ দেশের বিনিয়োগ দেখেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু দেশের ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর বাড়তি করভার চাপানো হলে দেশীয় বিনিয়োগ কমে যাবে কিংবা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কিংবা যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন তাদের জন্য বিশেষ সুদের হার নির্ধারণ করা যেতে পারে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শূন্য সুদের ঋণ রয়েছে। অথচ, আমরা ‘শূন্য সুদ’ এর ওপর কোনো কাজই করছি না। পুঁজি বাজারকেই এ কাজে ব্যবহার করা হয়। সেটা বাংলাদেশে হচ্ছে না। পুঁজি বাজারের ক্যাপিটাল এপ্রেসিয়েশন-ই এক্ষেত্রে অবদান রাখে।
পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলতে হলে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে যেতে হবে। বিনিয়োগ তথা শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় রয়েছে তার সবগুলোকে বিশ্ব প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির মধ্যে শিল্প উন্নয়নের বিষয়টি অনুপস্থিত। বেসরকারি খাতের উন্নয়নে অনেক কিছু করার থাকলেও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যেন কিছুই করার নেই। শিল্প মন্ত্রণালয় কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা নিয়েই ব্যস্ত। জানা গেছে একটি শিল্প স্থাপনে ১৭টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠাতে হয়। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে না। তাহলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ কি? জাপানে জেট্রো (জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন)ও কোরিয়াতে কোট্রা (কোরিয়া এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন) রয়েছে যারা বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়নে কাজ করে থাকে। মালয়েশিয়াতেও অনুরূপ সংস্থা রয়েছে। সময়ের দাবি মেটাতে জেট্রো বা কোট্রা এর অনুরূপ বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। এ সংস্থায় উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন প্রফেশনাল লোকবল দ্বারা পরিচালনা করা সম্ভব হলেই মূলত প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে। একইসঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ ইত্যাদির সঙ্গে যে সমস্ত মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে যেমন, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা আবশ্যক। এগুলোর টিওআর, কর্মপরিধি সংস্কার করা প্রয়োজন যাতে দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারে। এ সকল ক্ষেত্রে আমরা জাপানকে অনুসরণ করতে পারি।
বাংলাদেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ যদি উন্নয়ন করা যায়, তাহলে এখানে প্রচুর সম্ভাবনা বিদ্যমান, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিনিয়োগের জন্য এই দেশ এখন অনেকের প্রিয় হয়ে উঠছে। সাত অর্থনৈতিক পরাশক্তির নিকট বাংলাদেশের অবস্থা সুস্পষ্ট হয়েছে। এখন বিনিয়োগের কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে তবেই জাতীয় উন্নয়নের সোনার হরিণ ধরা দেবে। শুরু হবে নতুন এক বাংলাদেশের পথচলা।
n লেখক :প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (জেবিসিসিআই)