বিদেশি বিনিয়োগে সুবাতাস : ১০ মাসে ১৮২ কোটি ডলার বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে

মরিয়ম সেঁজুতি : দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। এই সময়ে ১৮২ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-বিওপি) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ১৮২ কোটি ডলার নিট বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে এসেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি ৫ লাখ ডলার।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে এটি দেশের জন্য ভালো খবর। তবে এতে অতি উৎসাহী হওয়ার কিছু নেই। সাধারণত বিদেশি বিনিয়োগ ইয়ার টু ইয়ার একটু বেশি ভেরিয়েশন হয়। এজন্য আগামীতে কী হয়, সেটিই দেখার বিষয়। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কয়েকটি সম্ভাবনাময় খাতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে। এর মধ্যে টেক্সটাইল, টেলিকমিউনিকেশন ও ব্যাংকিং খাত অন্যতম। দেশে বিদ্যমান অবকাঠামো সমস্যার সমাধান, দুর্নীতি রোধ ও জমির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন এ অর্থনীতিবিদ।

এফডিআই বৃদ্ধির বিষয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) যুগ্ম সচিব তৌহিদুর রহমান খান বলেন, এ প্রবণতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফসল। সার্বিকভাবে ইতিবাচক বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংও এ দেশের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহী করেছে। তিনি জানান, গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান ও ভারত থেকে। আর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, টেক্সটাইল অন্ড ওয়্যারিং, ব্যাংকিং, টেলিকমিউনিকেশন, বিদ্যুৎ, খাদ্য, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত জানান, সেতু, মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের এক ধরনের আবহ তৈরি হয়েছে। এতে দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছেন। দীর্ঘদিনের খরা কাটিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের পালে ‘হাওয়া’ লাগছে বলেই মনে হচ্ছে।

অবশ্য এফডিআইর এই পরিসংখ্যানে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই বলে মনে করেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রুপালী চৌধুরী। তার মতে, বাংলাদেশে এফডিআইর পরিসংখ্যানের ভিত্তি দুর্বল। এ কারণে শতাংশের হিসাবে ২১ শতাংশ শুনতে বা দেখতে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। প্রকৃত অর্থে অল্প এফডিআইর ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য কোনো অঙ্ক নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) হালনাগাদ তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অন্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড)। গত অর্থবছরের আগের বছর ২৪ জুলাই ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে ২০১৩ সালের চেয়ে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নিট বিদেশি বিনিয়োগ ৪ শতাংশের মতো কমেছে। গত বছরের জুলাইয়ের দিকে ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতে পারে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত সার্ভে প্রতিবেদন থেকে। বিনিয়োগ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে প্রথমবার বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ শত কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে। এর পর টানা ৩ বছর শত কোটি ডলারের ঘরেই আটকে ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। তবে গত বছর ওই বৃত্ত ভাঙতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বিদেশিদের জন্য সরকার প্রদত্ত নানা সুযোগ-সুবিধা এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ইকুইটি ক্যাপিটাল, রিইনভেস্টেড আর্নিং এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন- এই তিন ভাগে। এ তিন ভাগে আসা মোট অর্থপ্রবাহকে বলা হয় ‘গ্রস ফ্লো’।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ বাংলাদেশে নিয়ে আসছে, তা থেকে খরচ পুনরুদ্ধার (কস্ট রিকভারি) ও মুনাফার ভাগ (প্রফিট শেয়ার) হিসেবে যে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে বলা হয় ডিজইনভেস্টমেন্ট। গ্রস ফ্লো থেকে ডিজইনভেস্টমেন্ট প্রবাহ বাদ দিয়ে নিট প্রবাহ হিসাব করা হয়।

বছরওয়ারি হিসাবে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের গ্রস ফ্লো ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে সে বছর নিট ফ্লো ছিল ১৫০ কোটি ডলারে কিছু বেশি। ২০১৫ সালে নিট প্রবাহ ২২০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। বিদেশি বিনিয়োগের এই পরিমাণ ‘এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ’ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, এই সময়ে বিনিয়োগের গতি বেড়েছে, যা ‘সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের গ্রস ফ্লো ছিল ২০৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর ডিজইনভেস্টমেন্ট বাদ দিয়ে নিট প্রবাহের পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে নিট প্রবাহের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এক বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের নিট প্রবাহ বেড়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ একক কোনো বছরে প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। ওই বছর এর পরিমাণ ১১৩ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের ২ বছরও প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে। তবে ২০১৩ সালে প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা ভাটা পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়ে ১২৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারে ও ২০১৩ সালে ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়ে ১৫৯ দশমিক ৯১ লাখ ডলারে উন্নীত হয় বিদেশি বিনিয়োগ। তবে ২০১৪ সালে এফডিআই প্রায় ৪ শতাংশ কমে ১৫৫ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে।