রাজশাহীর আমের স্বাদ আর শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। চলে যাচ্ছে বিদেশেও। এ আমের খ্যাতি ইউরোপের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ায় সেখানেও ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক টন আম পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে আম পাঠানো হচ্ছে সব শর্ত মেনে। এর প্রধান শর্ত হল কেমিক্যাল ও কীটনাশকমুক্ত আম হতে হবে। এজন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্তত ৪০ চাষীকে আগেই প্রশিক্ষণসহ আম চাষের কলাকৌশল শেখানো হয়। এখন এ দুই জেলায় চলছে আমপাড়ার ধুম। রফতানিকারকদের হাত হয়ে তা চলে যাচ্ছে লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে। ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত এ আম বিদেশে পাঠিয়ে দ্বিগুণ মুনাফাও পাচ্ছেন চাষীরা।
তারা বলছেন, এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশের জন্য খুলে গেছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব ও গবেষণা কেন্দ্রের ঊধ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফুদ্দীন যুগান্তরকে জানান, তিনি গবেষণার কাজে চীনে গিয়ে দেখতে পান সেখানে বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগ দিয়ে ঢেকে আম উৎপাদন করা হচ্ছে। এরপর তিনি এ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে নিজেই প্রশিক্ষণ নেন।
এরপর দেশে ফিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুরে এ ব্যাগ তৈরির এক কারখানাও খোলা হয়। সেখানে তৈরি ব্যাগই কাজে লাগাচ্ছেন চাষীরা।
তিনি আরও জানান, পোকার আক্রমণ ও রোগবালাই দমনে ওষুধের বিকল্প হিসেবে ব্যাগিং পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এতে আমের প্রাকৃতিক রং ও গুণগতমান থাকছে অটুট। এসব আমের গুটি ছোট থাকা অবস্থায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তবে পাকার এক মাস আগে থেকে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ রেখে ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম সুরক্ষিত করা হয়। এতে আমে কোনো পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারেনি।
বর্তমানে ক্ষীরসাপাত আম বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এরপরই পাঠানো হবে ল্যাংড়া, আম্রপালি, লখনা, ফজলিসহ অন্যান্য জাতের আম। তিনি আরও জানান, রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশন ও হটেক্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট এসব আম কিনে নিয়ে বাজারজাত করছে। এরই মধ্যে পুঠিয়া থেকে ৫০০ কেজি, বাঘা থেকে তিন টন ও পবা থেকে দুই টন আম ইউরোপের কয়েকটি দেশে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও আম পাঠানো হবে। মঙ্গলবারও বাঘা থেকে এক টন আম পাঠানো হয়েছে। তবে এজন্য সরকারি দূতাবাসগুলোকে প্রচারের কাজ করতে হবে। তাহলে বিপুল বাজার তৈরি হবে। আসবে বৈদেশিক মুদ্রা।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগম জানান, এ উপজেলা থেকে ২০ আমচাষীকে ঢাকায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনায় এসব আম উৎপাদন করা হয়। মাছিপোকার আক্রমণ ঠেকাতে নানা রকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যাগিং পদ্ধতি ছাড়াও আম দূষণমুক্ত রাখতে বাগানের মাটি এবং সেচের পানিও পরীক্ষা করা হয়। ‘হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ পদ্ধতিতে শোধন করে হাতে গ্লাভস পরে এসব আম প্যাকিং করা হচ্ছে। আইনি ঝামেলা এড়াতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যৌথ সনদে এসব আম পাঠানো হচ্ছে।
ঢাকার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউকে-বাংলা এক্সপোর্টের স্বত্বাধিকারী তাপস দে বলেন, রাজশাহীর আম খুব সুস্বাদু। এ কারণে বিদেশেও প্রচুর চাহিদা। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমরা হয়তো আম পাব না। কারণ ব্যাগিং পদ্ধতিতে এবার বেশি আম উৎপাদন করা হয়নি। আরেক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মনীষা এন্টারপ্রাইজের আমিনুজ্জামান বলেন, ইউরোপের বাজারগুলোতে আমের চাহিদা থাকায় ভারত ও পাকিস্তান বাজার দখলের চেষ্টায় রয়েছে। কিন্তু রাজশাহীর আমের মতো তাদের আম মিষ্টি ও আকর্ষণীয় নয়। এ কারণে এ আমের বিপুল চাহিদা। লন্ডন, স্পেন, ইতালি, জার্মানি ও পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশের বাজার রাজশাহীর আমে ভরে গেছে।
নগরীর তেরখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম এবার তার বাগানের আম পাঠাচ্ছেন বিদেশে। তিনি বলেন, কার্বাইডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানোর কারণে বেশ ক’বছর ধরেই আম নিয়ে বিপাকে ছিলেন চাষীরা। অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে আম বাজারজাত করে আসছিল। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে এবার আমপাড়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে প্রশাসন।
তবে বিদেশে রফতানি করতে এবারই প্রথম ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করা হয়েছে। এতে নতুন করে আমের সুদিন ফিরবে। কারণ খোলাবাজারে এ আম বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে। কিন্তু আমরা একটু যত্ম করেই সে আম বিক্রি করতে পারছি ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে। এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৮২৫ টন আম বিদেশে রফতানী হয়েছিল। এবার প্রায় তিন হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় এবার আমবাগান রয়েছে ১৬ হাজার ৫৮৩ হেক্টর। আর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ৫৭৯ টন।