দেশের পতাকা ওদের হাতে

সাত বছর বয়সে বাবার কম্পিউটারে গেম খেলতে খেলতে শুরু। ১৪ বছর বয়সে রূহান হাবীব হয়ে গেল পুরোদস্তুর প্রোগ্রামার। শিক্ষক, প্রদর্শক ছাড়াই, শুধু ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে শিখেছে প্রোগ্রামিং-কোডিং। এখনও বয়স ১৬ হয়নি। সবে নবম শ্রেণীর ছাত্র। এ রূহানই জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন। সৈয়দ রুবাব রেদওয়ান ও তাসমীম রেজা তারই সমবয়সী। তিনজনই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রোগ্রামিং এক্সপার্ট।

আগামী আগস্টে রাশিয়ার কাজানে আন্তর্জাতিক ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডে (আইওআই) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে এ তিন কিশোরসহ চারজন।

তাদের কোচ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক কায়সার আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ওরা চারজনই অসাধারণ মেধাবী ও পরিশ্রমী। বাছাই পর্যায়ে সারাদেশের হাজার হাজার প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াই করে নির্বাচিত হয়েছে তারা। আগে প্রত্যেকবার আইওআই-এ বাংলাদেশ থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন। এবারই প্রথম স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে। ওরা সবাইকে হারিয়ে এই যোগ্যতা অর্জন করেছে। এটাই তাদের মেধার প্রমাণ।’ এই তিন কিশোর ছাড়াও আইওআই-এ অংশ নেবে নটর ডেম কলেজের ছাত্র নির্ঝর।

কোচের মতো অনেকেরই আশা, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে রূহান, রুবাব, রেজার মতো কিশোররা। কিন্তু কী করে এ কিশোররা প্রোগ্রামিংয়ের জটিল জগতে এলো, কতদূর যেতে চায়_ সেই গল্প জানতেই তাদের সঙ্গে কথা হয়। একেবারেই সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রূহান। তার বাবা ফজলুস সাত্তার একজন মানবাধিকার কর্মী। গত সোমবার সন্ধ্যায় রূহানদের শান্তিনগরের বাসায় গেলে তার বাবা অভ্যর্থনা জানালেন। রূহান তখনও ল্যাপটপে মগ্ন। কথা বলতে খুব একটা আগ্রহী নয়। ফজলুস সাত্তার জানালেন, সারাদিন প্রোগ্রামিং নিয়ে ডুবে থাকে। অন্য কিছুতে আগ্রহ নেই। একই উত্তর পাওয়া গেল রুবাবের বাবা অধ্যাপক সৈয়দ জাবিদ হোসাইনের কাছ থেকেও।

বাবার চোখের ধমকে কথা বলতে রাজি হলো রূহান। কিন্তু তাও ‘হু’ ‘হা’তে সীমাবদ্ধ। যখন প্রশ্ন করলাম প্রোগ্রামিং কী? প্রিয় প্রসঙ্গ পেয়ে জড়তা কেটে গেল। হাত নেড়ে নেড়ে দীর্ঘ বক্তৃতায় বোঝাল প্রোগ্রামিং কী, কী কী কাজে লাগে। অন্য প্রসঙ্গে যেতেই, আবার কথা ‘হু’ ‘হা’তে ফিরে গেল। তাই কথোপকথন কম্পিউটারের জগতেই আটকে থাকল।

কীভাবে শুরু হলো প্রোগ্রামিং? রূহান, রেজা ও রুবাব তিনজনের কাছ থেকেই একই রকম উত্তর পাওয়া গেল। রূহান জানাল, সে যখন ক্লাস ওয়ানের ছাত্র তখন বাসায় একটি কম্পিউটার ছিল। তার বাবা তাতে কাজ করতেন। যখন ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন এলো ল্যাপটপ। ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল। গেমস খেলা আর কার্টুন দেখতেই ল্যাপটপে পড়ে থাকত সে। এরপর হঠাৎ একদিন প্রোগ্রামিংয়ের খোঁজ পেল। প্রথমে ছোট্ট ছোট্ট কোডিংয়ে শুরু। তারপর আস্তে আস্তে বড় কোডিং করতে শুরু করল। তারপর নিজেকে যাচাই করতে অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করল। প্রথম প্রথম ফল খুব একটা ভালো হতো না। সময়ের সঙ্গে প্রোগ্রামিং রেটিং বাড়তে শুরু করল। ১৬ বছর বয়সেই রূহানের রেটিং ১ হাজার ৮৩৩। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত এক্সপার্ট। তারপর স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা শুরু হলো, তাতেও নাম লেখায় সে। ২০১৫ সালের জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় জুনিয়র বিভাগে রানার্সআপ হয়ে গেল। পরের বছর হলো চ্যাম্পিয়ন।

২০১৬ সালে ওই প্রতিযোগিতাতেই মিরপুরের হারমাইন ম্যাইনার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র রেজা রানার্সআপ হয়। তার বাসা মিরপুরে। বাবা রেজাউল ইসলাম পেশায় প্রকৌশলী। রেজাউল ইসলাম জানালেন, তিনি প্রোগ্রামিং অত ভালো জানেন না। ছেলের আগ্রহের কারণেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন। রেজারও প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল কম্পিউটার ঘাঁটতে গিয়ে। তারপর নিজে নিজেই শিখেছে কোডিং।

জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ছাত্র রুবাব। তার বাবা জাবিদ হোসাইন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। রুবাবের প্রোগ্রামার হয়ে ওঠা ছিল সবচেয়ে কষ্টের। কারণ রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতে হতো। এখনও নিয়মিত আসতে হয়। রুবাবের সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। তার বাবার সঙ্গেও কথা হয়। তিনি জানালেন, তিনি হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক। ব্যবসার অঙ্ক বোঝেন। কম্পিউটার বিজ্ঞান তার কাছে অপরিচিত। প্রোগ্রামিংয়ের কিছুই বোঝেন না। ছেলের আগ্রহের কারণেই নিয়মিত ঢাকা থেকে রাজশাহী ছুটেছেন। ক’দিন পার শুরু হচ্ছে ক্যাম্প। ছেলেকে আবার নিয়ে আসবেন। ছেলে আন্তর্জাতিক ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশ নেবে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। এ গর্বের কাছে রাজশাহী টু ঢাকা ছোটাছুটি খুব কষ্টের মনে হয় না। তিনি বলেন, ‘আসলে প্রোগ্রামিং কী তা বুঝি না। ছেলের আনন্দের কষ্ট করছি। আশা করি, ওরা বাংলাদেশের জন্য কিছু করবে।’

রুবাব জানাল, ভিজুয়াল বেসিক দিয়ে প্রোগ্রামিংয়ে তার শুরু। তখন সে ক্লাস ফোরের ছাত্র। বাসায় বড় ভাইয়ের একটি কম্পিউটারের বই ছিল, তা দেখে দেখেই কোডিং শুরু করে। তারপর অনলাইনে বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেয়। তার রেটিং পয়েন্ট এখন ১ হাজার ৭০২। রুবাবও একজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রোগ্রামিং এক্সপার্ট। ২ হাজার ৪০০ পয়েন্ট পেলে হবে গ্র্যান্ড মাস্টার। ২ হাজার ৯০০ পয়েন্ট পেলে হবে লিজেন্ড। তিনজনেরই লক্ষ্য আগামী দুই বছরের মধ্যে লিজেন্ড হওয়া।

লিজেন্ড হওয়া তো দুই বছর পরের ব্যাপার। আর দুই মাস পরেই তো আইওআই। এর আগে বাংলাদেশ একবার রৌপ্য পদক পেলেও এখনও স্বর্ণের পদকটি অধরা। সেবার অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন। এ প্রতিযোগিতায় অবশ্য সর্বোচ্চ দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারে। তবে সদ্য কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও অংশ নিতে পারেন।

আগেই বলেছিলাম তিন কিশোরই কথাবার্তায় অনেক সোজাসাপ্টা। আইওআই-এ কি ফল আশা করছ? এ প্রশ্নের উত্তরও এলো সোজাসাপ্টা। তারা স্পষ্ট জানায়, স্বর্ণপদক জয়ের কোনো আশা নেই। রূহান বললো, আমাদের যতটা প্রস্তুতি দরকার, ততটা নেই। বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। অন্যান্য দেশে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। তারা অনেক দক্ষতা অর্জন করেছে। একই উত্তর পাওয়া গেল রুবাবের কাছ থেকে। তাদের কোচ কায়সার আবদুল্লাহ বলেন, ‘ রূহান, রুবাব, রেজা এখনও স্কুলে পড়ে। এবারই প্রথম অংশ নিচ্ছে। তাই বড় আশা না করাই ভালো। তাদের যে বয়স তাতে আরও তিনবার তারা আইওআই-এ অংশ নিতে পারবে। যদি লেগে থাকে, পরিশ্রম করে তাহলে আগামীতে ভালো হবে। আগের প্রতিযোগীরা এ সুযোগটি পায়নি।’

রূহানের বাবা ফজলুস সাত্তার বললেন, ভারতে, ইরানে যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয় সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। উন্নত দেশে যেসব শিক্ষার্থী প্রোগ্রামিংয়ের মতো সৃজনশীল কোনো কাজে দক্ষ তাদের আলাদা স্কুলে পড়ানো হয়। তারা আরও বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সহায়তা নেই।

রেজাউল ইসলাম বললেন, শুধু বুয়েট চেষ্টা করছে। অন্য কেউ চেষ্টা করছে না। শুধু বুয়েটের চেষ্টায় পর্যাপ্ত সংখ্যায় তথ্য প্রযুক্তিবিদ তৈরি করা সম্ভব নয়। বুয়েটের অবদানের কথা স্বীকার করলেন, তিন কিশোরের অভিভাবক। রূহানের বাবা বললেন, একমাত্র বুয়েটে মাঝে মধ্যে ওদের ডেকে নেয়। প্রশিক্ষণ দেয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।

এই তিন কিশোরের মেন্টর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘রূহান, রেজা ও রুবাব বিস্ময়কর প্রতিভা। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হারিয়েছে। আশা করছি, ওরা একদিন অনেক বড় কিছু করবে।’