গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন

২০১৫ সাল হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের একটি সেরা সময়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০১২ সালে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ড বেরিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিএনএন মানি বাংলাদেশকে ২০১৫ সালের পঞ্চম দ্রুততম জিডিপি প্রবৃদ্ধির (৬.৮%) দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৬ সালে এই গতিতে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান অধিকার করবে। সিএনএন মানির মতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জিডিপি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির গতিতে চীনের পেছনে (৯.২%) ও ঠিক ভারতের (৬.৮%) সামনে থাকবে। ২০১৫ সালে জিডিপির ৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার রাজনৈতিক স্থবিরতার ভেতর দিয়েও ছিল আশানুরূপ। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফালান্ড ও ইংল্যান্ডের ডক্টর জেক আর পারকিনসন তাদের গবেষণা প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশ :আ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট ১৯৭৬’-এ উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থায় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে অর্থনীতিতে উন্নয়ন অসম্ভব। তবে বাংলাদেশ যদি এ পরিস্থিতিতেও উন্নতি করতে পারে, সেটা হবে একটা বড় চ্যালেঞ্জ এবং এ উদাহরণকে ভিত্তি করে পৃথিবীর যে কোনো জাতি নিজেদের উন্নয়ন করতে সম্ভব। সেই থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তারা কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডক্টর কাওসিক বাসু উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নতুন বাঘ বলে অভিহিত করেছেন।
দি ইকোনমিস্ট ২০১২ সালের তৃতীয় ইস্যুতে উল্লেখ করেছে, ‘কী করা সম্ভব, তার একটি উন্নত মডেল হলো বাংলাদেশ। কীভাবে একটা দেশ উন্নয়নের মডেল হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশ।’
দারিদ্র্য হ্রাস ও শক্তিশালী মধ্যবিত্ত :দারিদ্র্য হ্রাস ও উচ্চ ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যবিত্তের ক্রমবিস্তার বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বাড়তি সহায়তা দিয়েছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটা তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোক আছে, যারা পাঁচ হাজার ডলার পার কেপিটা উপার্জনে অতি উন্নতমানের ও উচ্চমূল্যের দ্রব্য ক্রয় করতে সক্ষম। বিসিজি এটাকে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক বলে মনে করে।
সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন :বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সেখান থেকে বাংলাদেশ বিস্ময়করভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭১, শিক্ষার হার ৬০ শতাংশ অতিক্রম করেছে এবং মাথাপিছু আয় পিপিপি ডলারে তিন হাজার ৫০০ ডলার ছুঁয়েছে। জনসংখ্যার বার্ষিক বৃদ্ধি হ্রার কমে ১.১৩ শতাংশে এসে নেমেছে। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩১ শতাংশে এসে পেঁৗছেছে। প্রাথমিক শিক্ষা শতভাগে পেঁৗছেছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষায় তুলনামূলক বিবেচনায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে। শতকরা ৫৩ ভাগ মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষায় জড়িত। ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার, সেটা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখের বেশি। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এর হার শত গুণের বেশি। ১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করত। দারিদ্র্য হ্রাসের হারে বাংলাদেশ আশানুরূপ সফলতা অর্জন করায় সে সংখ্যা বিস্ময়কর হারে কমেছে। ২০১৫ সালে সাড়ে ১৬ কোটির মধ্যে এখন দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করে সাড়ে তিন কোটি মানুষ। উন্নয়নের এই প্রচেষ্টায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে প্রবেশ করেছে। ৫৪ হাজার উচ্চবিত্ত পরিবারের সম্পদ দেড় কোটি টাকার ওপর। প্রতিবছর এই শ্রেণীতে পাঁচ হাজার করে উচ্চবিত্ত পরিবার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। তবে আরও পরিশ্রম করলে খুব শিগগির বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণের আশা প্রকাশ এবং সে পদক্ষেপকে আরও নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করার ক্ষেত্রে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা দেশে আরও বেশি করে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হওয়ার পর সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা ব্রিজ, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের হাইওয়ে, ময়মনসিংহ কিংবা সিলেটে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা এবং দ্রুত ও নিরাপদ সড়কের জন্য নানা রকমের পদক্ষেপ প্রশংসার দাবিদার।
একটি দেশের উন্নয়নে সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শক্তিশালী দক্ষ মানব উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশে সেটা ধীরে ধীরে ঘটছে। ১৯৭৩-এ যখন বাংলাদেশে মাত্র পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেখানে বর্তমানে ১২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। শিক্ষাক্ষেত্রের সর্বস্তরে সর্বমোট সাড়ে চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান শিক্ষাবছরসহ প্রায় দুইশ’ কোটি বই সম্পূর্ণ ফ্রি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরেও শতভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। মাঝপথ থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটির ওপর, ১৯৭২-এ যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার।
নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ :বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭-এর প্রবৃদ্ধির হারের একটি পরিপূর্ণ রেখাচিত্র তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬ সালে ০৭ ভাগ, ২০১৭ সালে ৭.৫ ভাগ ও ২০১৮ সালে ৮ ভাগে বৃদ্ধি পাবে এবং এ গতিতে এগোলে বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে দ্বিগুণ আকারের প্রবৃদ্ধির হারে পেঁৗছে যাবে। এরই মধ্যে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘ কর্তৃক চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ অর্জন, আইটিইউ কর্তৃক সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট মেডেল এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের স্বীকৃতি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুন্দর সোনার বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে আরও সুসংহত করেছে। ওয়াশিংটনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নাল শেখ হাসিনাকে বিশ্বের ১০০ জন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের মাঝে ১৩তম অবস্থানে রেখেছে, যা তার দক্ষ নেতৃত্বের একটি মাইলফলক ও সফলতাকেই নির্দেশ করে, এর আগে যেমনটা কখনও ঘটেনি।