টাকার প্রবাহ হবে গ্রামমুখী

আগামী অর্থবছরের বাজেটে টাকার প্রবাহ হবে গ্রামমুখী। বিশেষ করে বড়-বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন, গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক জোন নির্মাণ, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল সম্প্রসারণ, বিসিকের শিল্পনগরী পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি নতুন শিল্পনগরী স্থাপন, ঢাকা খুলনা রেললাইন নির্মাণ, দারিদ্র্য বিমোচন, বিভিন্ন ভাতা, অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশই যাবে গ্রামে। এছাড়া কৃষিঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ, গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে ঋণের বেশিরভাগ অংশই যাবে গ্রামে। ফলে আগামী বাজেটে অর্থের একটি বড় অংশকেই গ্রামমুখী করা হবে।

সূত্র জানায়, আগের বাজেটগুলোয় এসব খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ৫৬ শতাংশই যেত গ্রামে, আর এবারের বাজেটে যাবে আরও বেশি অংশ। কেননা যে বড়-বড় অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই গ্রামে হবে। এছাড়া এসব অবকাঠামোর বেশিরভাগ সুবিধা পাবেন গ্রামের মানুষ। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার পরোক্ষভাবে এসব উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার মনে করে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হলেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। তখন গ্রামে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হবে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

এ লক্ষ্যে সরকার এবারের বাজেটের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়াতে গ্রামীণ চাহিদা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। এটি হলে পণ্যের চাহিদা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।

জানা গেছে, আগামী বাজেটে স্থানীয় সরকার বিভাগে মোট বরাদ্দের পরিমাণ হবে ২১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি বাজেটে এ সেক্টরে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সে হিসাবে নতুন বাজেটে স্থানীয় সরকার বিভাগে অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশই যাবে গ্রামে।

এ ছাড়া নতুন বাজেটে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পরোক্ষভাবে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রোথ সেন্টার নির্মাণ, হাট-বাজার উন্নয়ন কার্যক্রমসহ আগামী তিন বছরের মধ্যে সারা দেশে ১৪ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাকা করার ঘোষণা। একই সঙ্গে কাঁচা রাস্তা পাকা করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করা হবে। আরও থাকছে ৩৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, পাকা সড়কের মধ্যে ৮৪ হাজার ৩০০ মিটার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ পরিকল্পনা।

সূত্র জানায়, এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের দৃশ্যমান বড় বিনিয়োগে আলাদা নজরদারি করা হবে। এজন্য পিডি পুল তৈরি করে এর মাধ্যমে টাকার প্রবাহকে গ্রামমুখী করা হবে। এডিপি বাস্তবায়নের বড় অংশও গ্রামেই ব্যয় হচ্ছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে আগামী বাজেটে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া আগের বরাদ্দ টাকার একটি অংশও আগামী অর্থবছরে খরচ হবে। ইতেমধ্যে সেতুর মূল কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফলে এ খাতে ব্যয় হওয়া টাকার একটি বড় অংশ যাবে গ্রামে। এ সেতুকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিমালঞ্চলে নানা অবকাঠামো গড়ে উঠছে। সরকারিভাবে দেশের ১৯টি জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতুর সঙ্গে ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পে স্থানীয়ভাবে যেসব টাকা খরচ হবে তার একটি বড় অংশ যাবে গ্রামে। এর জন্য আগামী বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকছে।

বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। নতুন করে রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, তিন স্তরের তিনটি সার্কুলার রোড তৈরিসহ কয়েকটি বড় ধরনের কর্মসূচিও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশব্যাপী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার কর্মসূচিও রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে নতুন ৬০টি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যানজটমুক্ত ঢাকা শহর গড়ে তুলতে মেট্রো রেলওয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের টাকার একটি অংশও যাবে গ্রামে।

গ্রামীণ অবকাঠামোগুলো নির্মিত হলে একদিকে যেমন অর্থের প্রবাহ গ্রামমুখী হবে, অন্যদিকে গ্রামীণ যোগাযোগ সহজ হবে। তখন পণ্যের বিপণন বাড়বে। একই সঙ্গে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার পথ সুগম হবে। এতে চাঙ্গা হবে গ্রামীণ অর্থনীতি।

দেশে আগামী অর্থবছরের মধ্যে ১০টি অর্থনৈতিক জোন নির্মাণের কাজ চলছে। এগুলোতে কমপক্ষে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ৬ হাজার কোটি বিনিয়োগ হবে। এর বড় অংশই যাচ্ছে গ্রামে। এর ফলে ওইসব অঞ্চলে জমির উন্নয়ন হচ্ছে। একই সঙ্গে দামও বাড়ছে। এতে গ্রামীণ সম্পদের মূল্য বেড়ে যাবে।

বেসরকারি বিনিয়োগকে চাঙ্গা করতে আগামী অর্থবছরে পিপিপি খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। ওই টাকার একটি অংশ আগামী অর্থবছরে স্থানান্তর করা হবে।

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার অন্যতম খাত পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করা। এ লক্ষ্যে সরকার ট্যুরিজম ইজেড নির্মাণের একটি নতুন ধারণা নিয়ে এগোচ্ছে। কক্সবাজারের সাবরাংয়ে একটি ট্যুরিজম ইজেড নির্মাণ শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে এটি পর্যটকদের জন্য উš§ুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া টেকনাফে নাফ নদীতে আরেকটি ট্যুরিজম ইজেড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, এখন উন্নয়নের প্রবাহকে গ্রামমুখী করতে হবে। কেননা গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তারা বেশি পণ্য কেনে। ফলে ব্যবসায়ীরা বেশি ব্যবসা করার সুযোগ পান।

চলতি অর্থবছরে গ্রামীণ এলাকায় কৃষি ও পল্লি ঋণ বাবদ ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর এই খাতে ব্যাংকগুলো ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চলে ১২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। গত বছরের একই সময়ে ১১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। এক বছরের ব্যবধানে গ্রামে কৃষি ও পল্লি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে এই খাতে ঋণপ্রবাহ আরও বাড়ানো হবে।

এ ছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলে বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) অর্থ সরবরাহ করছে। ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত বিআরডিবি ৫৬৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক গ্রামে ১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।

ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, জাগরণী চক্র, প্রশিকা, টিএমএসএস ইত্যাদি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা ও এনজিও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে গ্রামে ৬ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতি ৩৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। অধিকাংশ ঋণই গ্রামাঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গ্রামীণ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবছর ঋণের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। এতে উৎপাদন বাড়ছে। গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। কৃষি ও ছোটখাটো শিল্প খাতেও ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে টাকা যাচ্ছে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রামের অর্থনীতিতে টাকার জোগান বাড়াচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্চে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সর্বমোট ১৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা লেনদেন হয়। গড়ে প্রতিদিন লেনদেন ৬০৮ কোটি টাকা। মোবাইল ক্যাশ ইন করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। ক্যাশ আউট করা হয়েছে ৭ হাজার ৫০ কোটি টাকা। শহরে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি চালক, গার্মেন্টকর্মীসহ অন্যান্য স্বল্প আয়ের মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছে।

সবচেয়ে বড় মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের প্রধান নির্বাহী কামাল কাদির বলেন, আমরা একটি এসেসমেন্টে দেখেছি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ৯০ শতাংশ লেনদেনই গ্রামমুখী। বিভিন্ন কাজে যারা শহরে কাজ করতে এসেছেন তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা গ্রামে পাঠাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৭৬ শতাংশ রিকশাচালক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠান। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বেশির ভাগ অর্থও যাচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) প্রবাসীরা ১ হাজার ২৫৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৪৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রেমিট্যান্সের বড় অংশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো অর্থের অধিকাংশ, গ্রামে যাচ্ছে। গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এসব অর্থ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।