রওশন আরা মুস্তাফিজ
কাজী নজরুল ইসলাম তার ভরা যৌবনে আপন কবিসত্তা অনুভব করে বলেছিলেন, ‘আমি কবি। বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করার। কাহারও ভালো লাগিলেও গাই, ভালো না লাগিলেও গাহিয়া যাই।’ যৌবনের মধ্যসীমায় কবির বক্তব্য, ‘যৌবনের সীমা পরিক্রমণ আজো আমার শেষ হয় নাই, কাজেই আমি যে গান গাই তাহা যৌবনের গান।’ তারুণ্যদীপ্ত যৌবনের পূজারি কবি নজরুলের সমগ্র রচনা সম্ভারে রয়েছে চিরসত্য ও চিরসবুজের প্রতিধ্বনি। অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতাঙ্গনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল, স্থির, অচঞ্চল এক কাব্য প্রতিভার নাম। ধূমকেতুর মতো অতি স্বল্প সময়ে তার আবির্ভাব, আবার মাত্র দুই দশকের কিঞ্চিৎ অধিক সময়ে (১৯২০ সালের মার্চ থেকে ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই, মোট ২২ বছর তিন মাস) সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভুবনে অবস্থান করে অকস্মাৎ এই মোহময় জগৎ ত্যাগ করে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া। অথচ তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল।
কি সাহিত্য, কি সঙ্গীত, প্রতিটি ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল অনায়াসলব্ধ। সারা জীবন তিনি সাধনা করেছেন সত্য, সুন্দর ও সাম্যের। সংগ্রাম করেছেন অত্যাচার, অনাচার, অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের প্রতি পদে পদে তাকে পরাধীন দেশের ইংরেজ শাসকদের নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের অন্যায় তার মাথা নত করতে পারেনি। প্রথম যৌবনের সৈনিক জীবনে তিনি সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে দীক্ষা পেয়েছিলেন তা তাকে পরবর্তী সময়ে এক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পেঁৗছে দিয়েছে। পরাধীন দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য, পরাধীন দেশের নিষ্পেষিত জনগণের হৃদয়ে সৃষ্টি করেছেন শৃঙ্খল মুক্তির অদম্য সাহস, ভয়কে জয় করার উৎসাহ-উদ্দীপনা। তাই তার জাগরণী গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসঙ্গীত আজও গণমানসের দীপ্ত চেতনায় ভাস্বর। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের গান মুক্তিপাগল মানুষের চেতনাকে করেছে উজ্জীবিত, স্বাধীনতাকামী সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে দিয়েছে মুক্তির প্রতিভাস।
নজরুল তার সমগ্র জীবন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দীক্ষায় ‘শির নেহারি আমারি, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির’ ব্রত অবলম্বন করেছেন। তার প্রতিটি কাব্য, সঙ্গীত তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠক-শ্রোতার কাছে অনায়াসে তার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত রূপ তুলে ধরেছে। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতে নজরুল তার নিজস্ব মহিমায় সৃষ্টি করেছেন এক অপরূপ সুন্দর ভুবনের। বিশেষ করে তার সঙ্গীতের জগৎ সমগ্র বাংলা গানের ভুবন নানা বৈচিত্র্যে ভরিয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গীতে তিনি শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাংলা ভাষার সঙ্গে উর্দু, আরবি, ফারসি শব্দের সমাহার দিয়ে গীতিকবিতার নতুন রূপ দান করেছেন। কবির রচিত অসংখ্য গানের মধ্যে যদি শুধু গজল গানের কথাই ধরা হয়, তাহলে দেখা যায় তিনি যেভাবে গজল গানের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন তা তার আগে বাংলায় আর কোনো গীতিকারের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। কবি প্রেমিক হৃদয় দিয়ে গজল গানের মর্মার্থ এমনভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে গজলের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং পরিবেশন ভঙ্গি এসবই তার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। তাই বাংলা গানে গজল মানেই নজরুল, নজরুল মানে গজল_ এ কথা এক সময় যেমন সমার্থক হয়ে গিয়েছিল, আজও তার গজল গানে মর্যাদা এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি।
নজরুলের বিপুল গানের ভাণ্ডারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার কথা বাদ দিয়ে যদি শুধু তার গজল গানের মূল্যায়ন করা যায়, তাহলে দেখা যায় তিনি সুরের ভুবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এত মনোযোগ সহকারে অবলোকন করেছেন এবং সুরের ধ্যানে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন যে তার পক্ষে গজল গানের রাগ-রাগিণীভিত্তিক আবহ রচনা করা মোটেও কষ্টসাধ্য হয়নি। যে কোনো গজল গানের মেজাজ ও ভাব সুরের ঐশ্বর্যে দীপ্ত করার প্রখর ক্ষমতা তার ছিল। সঙ্গীতের প্রতি তার অসীম প্রেম তাকে সেই সময়ের বিভিন্ন সঙ্গীতের আসর বা জলসার মধ্যমণি করে তুলত। সেসব সঙ্গীতের আসরে সেই সময়কার কোনো ওস্তাদ বা গুরুর গাওয়া গানের কোনো অংশ বা চরণ তিনি মর্মে অনুধাবন করে পরবর্তী সময়ে সেই সুর একান্ত নিজস্ব আঙ্গিকে কথা ও সুরের মোহময় বিস্তারে প্রকাশ করেছেন সঙ্গীতপ্রেমী অগণিত শ্রোতার সামনে। সঙ্গীত কবি রচনা করেছেন কখনও কোনো নৃত্যপটীয়সী গায়িকার মন মাতানো সুরের অনুসরণে। কখনও-বা কোনো দরিদ্র পথচারী কাওয়ালের সুর অবলম্বনে। বিদেশি গানের সুরের আবেশে তার রচনা_ আসে বসন্ত ফুলবনে, সাজে বনভূমি সুন্দরী এবং পথচারী কাওয়ালের গানের সুর নিয়ে কবি চয়ন করলেন অমর গজল_ নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরাণ পিয়া।
নজরুল তার স্বল্পস্থায়ী সঙ্গীত জীবনে এত দ্রুতগতিতে অজস্র গান রচনা করেছেন যে, সেই সময়কার বহু গীতিকার মনে করতেন, তার গান বোধহয় আগামী প্রজন্মের জন্য গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু তার সমসাময়িক কালেই দেখা গেছে, তার গান লেখার পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। কখনও তিনি গানের সুর মনে ধারণ করার পর তার ওপর কথা বসিয়েছেন এবং কথার মালা গেঁথে তার ওপর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সুরারোপ করেছেন। ঋতুভিত্তিক গানে কবি যখন বর্ষার গান লিখেছেন তখন বর্ষার রাগ মেঘ, মিঞাকী, মালহার, জয়জয়ন্তী প্রয়োগ করেছেন। তার লেখা_ ‘মেঘ মেদুর বরষায় কোথা তুমি’ গানটি রাগ জয়জয়ন্তীতে নিবদ্ধ। আবার বসন্তের গান ‘এলো ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত’ গানটি রাগ বসন্তে রচনা করেছেন। সুরের জগতে তার অবগাহন তাকে বিভিন্ন বৈচিত্র্যধর্মী সঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত শ্রুতিধর। তিনি উদার চিত্তে অসংখ্য গান লিখেছেন বটে, কিন্তু তার গানে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি কখনও তার নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট ঘটনার উদাহরণ মনে পড়ল। একবার কবি তার একজন সঙ্গীতজ্ঞ বন্ধুর বাড়িতে বসে চা পান করছিলেন। পাশের ঘরে একজন ছাত্র তার একটি গজল গান_ ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা মনে রহিল আঁকা’ গাইছিল মনোযোগ সহকারে। অন্তরার একটি কলিতে সে গাইল_
এত শঠতা এত যে ব্যথা
তবু কেন তা মধুতে মাখা।
কবি সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রটির ভুল শুধরে দিয়ে বললেন, ‘ওরে ওই শব্দটি ‘কেন’ নয় যেন হবে। নজরুল অজস্র গান রচনা করেছেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে, কিন্তু তার স্বচ্ছ চিন্তাধারার ক্ষেত্র শব্দ প্রয়োগে তিনি যেখানে যা যথাযথ তা সচেতনভাবে লিখেছেন। সুরের ক্ষেত্রে তিনি কোন গানে কোন রাগ প্রয়োগ করা প্রয়োজন তা গভীর অভিনিবেশ সহকারে অনুভব করেছেন। সকালের গানের কথায় সকালের রাগ ভৈরবী, ভায়রো, ললিত, জৌনপুরী, টোডি প্রভৃতি যেমন রচনা করেছেন তেমনই কোন রাগে গানের বাণীর মাধুর্য সত্যিকার অর্থে ফুটে উঠবে সে বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তাই এত স্বল্প সময়ে লেখা অজস্র গান শ্রোতার হৃদয়ে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
নজরুলের কাব্যসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, ভক্তিসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, হাসির গান, হিন্দি গীতি, সর্বোপরি তার লেখা অসংখ্য জনপ্রিয় গজল বাংলা গানের জগতে তার আসন চিরস্থায়ী করে রেখেছে। কবি চিরদিন যে সত্য ও সুন্দরের ধ্যান করেছেন, সাম্যের গান গেয়েছেন তা তাকে এক ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। চির নতুনের জয়ধ্বনি করে কবি পরাধীন দেশের নির্জীব মানুষের হৃদয়ে আশার আলো উদ্দীপনার মশাল জ্বালিয়েছেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের জাগরণী গান আবার নতুন উদ্যমে, দুর্দান্ত ঝড়ের গতিতে সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষের অন্তরে। তার আদর্শ পথে, সত্য, সুন্দর, সাম্যের গানের অনুপ্রেরণায় বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মানুষ উজ্জীবিত হবে যুগে যুগে।