ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে যার ফলে বিভিন্ন খাতের উন্নতি হচ্ছে দৃশ্যমানভাবে। এর পেছনে রয়েছে ব্যক্তির আগ্রহ, বেসরকারি খাতের উদ্যোগ এবং সরকারের প্রণোদনা। এই যৌথ প্রয়াসের ভিত্তিতে গত কয়েক বছরে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত প্রসার ঘটেছে। ২০২০ সালের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারি পর্যায়ে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে অংশগ্রহণ করছে শিক্ষিত সকল শ্রেণির মানুষ। যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা পায়নি সেই সব নর-নারীও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছে। এখন গ্রামের কৃষক থেকে রিকশাওয়ালা সবার হাতেই দেখা যায় মোবাইল। মোবাইলের সাহায্যে তারা কেবল ব্যক্তিগত আলাপ এবং খবরাখবরই আদান-প্রদান করছে না, বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটা ও বিক্রি এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে টাকাও পাঠাচ্ছে। শিক্ষার প্রসার ঘটলে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যে আরো সম্প্রসারিত ও ব্যাপক হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
মাঝে-মাঝেই সংবাদপত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপকহারে অগ্রগতি সম্পর্কে সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়, যার মাধ্যমে এ বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে শুধু পাঠকের কাছে পৌঁছেই যাচ্ছে না, তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবসায়েও উপকৃত হচ্ছে। এই দুই কারণে মিডিয়া, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া ডিজিটাল প্রযুক্তির খবরাখবর নিয়মিত পরিবেশন করে যাচ্ছে; যার ফলে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে পাঠক অনেক কিছু অবগত হতে পারছে। সম্প্রতি প্রিন্ট মিডিয়ায় বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে অন্তর্ভুক্ত প্রধান তথ্যগুলো ছাপা হওয়ায় পাঠকেরা বেশ কিছু নতুন তথ্য জানতে পেরেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৬ : ডিজিটাল প্রযুক্তির লাভ’। প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে একটি উন্নয়নমূলক বিষয়ের ওপর তথ্য পরিবেশন করে বিশ্লেষণ করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর কোনো দেশ কতটুকু উপকৃত হয়েছে এবং তাদের কী পরিমাণ লাভ হয়েছে ২০১৬ সালের বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রতিবেদনে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ ভিত্তিক আলোচনা হওয়ার কারণে প্রতিবেদনটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রথমেই যে বিষয়টি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো ইন্টারনেট ব্যবহকারীদের সংখ্যার উল্লেখ। ইন্টারনেট ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রধান অঙ্গ এবং এর চালিকাশক্তি। সে জন্য কোনো দেশে এর ব্যবহারকারী শতকরা কত ভাগ সেই তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যে দুটি পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে তা বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরস্পরবিরোধী। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী ২০১৪ সালের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ১৪৮ মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা পায়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ১৬০ মিলিয়ন ধরা হয় তাহলে এই হিসেব অনুযায়ী মাত্র ১২ মিলিয়ন নাগরিক ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। অপরদিকে বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ৬১ মিলিয়ন নর-নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এই দুই হিসেবের মধ্যে পার্থক্য বিশাল, যার জন্য এর পেছনের কারণ জানা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নিয়ে যে বিরোধ তার কারণ ‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পৃথক সংজ্ঞা ব্যবহার’। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি তিন মাসে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তাকে ব্যবহারকারীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী যারা নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং যাদের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ আছে তাদেরই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বলা হয়। স্পষ্টতই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থা খুব নমনীয়ভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা যায় না। এর ফলে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে এবং এই ধারণা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সূচক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কর্তৃপক্ষ সংজ্ঞা ব্যবহারে এই দুর্বলতা অর্থাত্ ত্রুটি সংশোধনে তত্পর হবে বলে আশা করা যায়।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান সঠিক বলে গ্রহণ করা হলেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশের ওপরে রয়েছে বলে দেখা যায়। যেমন ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে না এমন মানুষের সংখ্যা ১ (এক) বিলিয়নের ওপর। চীনে এই সংখ্যা ৭৫৫ মিলিয়ন। ব্রাজিলে ৯৮ মিলিয়ন, মেক্সিকোতে ৭০ মিলিয়ন, পাকিস্তানে ১৬৫ মিলিয়ন এবং ইন্দোনেশিয়ায় ২১৩ মিলিয়ন। (উত্স : বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক উন্নয়ন প্রতিবেদন)। এসব পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে তা খুব নিরুত্সাহজনক বলা যাবে না।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির যে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোযোগ আকর্ষণ করে তা হলো এই খাতে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি। এখানে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে বলে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট কর্মসংস্থানের মাত্র শতকরা ০.৫ ভাগ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের সৃষ্টি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের প্রযুক্তি-দক্ষ নতুন প্রজন্ম সফটওয়্যার তৈরিতে সাফল্য অর্জন করেছে এবং বিদেশে এর রফতানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রযুক্তিতে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে এখনো তৈরি না হলেও এসবের মেরামতের জন্য একটা প্রাণবন্ত খাত সৃষ্টি হয়েছে। এখানেও অর্ধশিক্ষিত এবং শিক্ষিত শ্রেণির কর্মীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। সরকারি বেশ কিছু অফিসে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের কাছে সেবা অনলাইনে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। যেমন অধিকাংশ অফিসই এখন টেন্ডার ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে আহ্বান করা হয়ে থাকে যা ব্যবহারকারীদের জন্য খুব সুবিধাজনক এবং অনিয়ম নিরসনে কার্যকর। বিদ্যুত্, পানি এবং গ্যাসের বিলও এখন অনলাইনে দেওয়া সম্ভব যা ব্যবহারকারীদের ঝামেলামুক্ত করেছে। এসব কাজে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অবশ্য নতুন কর্মসংস্থান করেনি এজন্য যে আগে যারা কাগজ-কলম ব্যবহার করা হয়ে কাজ করতেন তারাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির একটা সফল ব্যবহার হলো প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদকে এই নতুন যোগাযোগ মাধ্যমের আওতায় নিয়ে আসা। এর ফলে খুব বেশি সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান না হলেও গ্রাম পর্যায়ে প্রযুক্তির প্রচলন সম্ভব হয়েছে যা ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হয়েছে শহর থেকে গ্রামে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে। এর ফলে দূর-দূরান্তের মানুষ যেমন দ্রুত তাদের নামে পাঠানো টাকা পেয়ে যাচ্ছে, একই সঙ্গে অর্ধশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত অনেক সাধারণ মানুষ অর্থ উপার্জনের (সেবা প্রদানকারী হিসেবে) সুযোগ পেয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার তখন উপকার বা লাভ নিয়ে আসবে যখন এর ভিত্তিতে উত্পাদন, কেনা-বেচার প্রসার ঘটবে। ডিজিটাল প্রযুক্তিকে প্রধানত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করা হলে এর ভূমিকা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি হাতে নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দ্রুতগামী ইন্টারনেটের সীমাবদ্ধতার প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ফোর-জি অর্থাত্ চতুর্থ প্রজন্ম শিল্প পর্যটন করা হলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সরকারের উদ্যোগে প্রায় ২০০ ওয়েবসাইট নিয়ে যে জাতীয় পরিসংখ্যান কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে তার ফলেও ডিজিটাল প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার সম্ভব হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য যে ফি ধার্য করা হয়েছে তা বেশি বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এই ফি হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে সীমাবদ্ধতার একটি প্রধান কারণ হলো গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের অধীনে নিয়ে আসার ধীর গতি। এই সমস্যা দূরীকরণে মোবাইল কোম্পানিগুলো জরুরি পদক্ষেপ নিলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বাড়বে কর্মসংস্থানেও অবদান রাখবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার জন্য যে ফি আদায় করা হয় তা বেশ কম। মোবাইল কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ লাভ করছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে এই ফি হ্রাস করার অবকাশ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মোবাইল কোম্পানিগুলো বিশেষ অবদান রেখেছে। তবে তারা মাঝে-মাঝেই অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাঁটাই করে নতুন কর্মী নিয়োগের যে নীতি অনুসরণ করে তা পরিহার করা উচিত।