দুর্যোগে ফসল রক্ষায় দৃষ্টান্ত

বিশ্বম্ভরপুরে রাবার ড্যাম

চলতি বছর আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর, ধরমপাশা, তাহিরপুর, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ধান তলিয়ে গেছে। অথচ একই জেলার হাওরাঞ্চল বিশ্বম্ভরপুর ছিল ব্যতিক্রম। ঘাগটিয়া নদী ও চলতি নদীর মোহনা থেকে গজারিয়া খাল পর্যন্ত তৈরি করা রাবার ড্যাম বাঁচিয়ে দিয়েছে এই এলাকার কৃষকদের। এখানকার করছার হাওরে বন্যা-বানের পানি ঢুকতেই পারেনি। রক্ষা পেয়েছে ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো আবাদ। খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এই ড্যাম নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় পাহাড় ও চেরাপুঞ্জি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এই এলাকায়। এর প্রভাবে ভাটিতে হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল আর বন্যাও নৈমিত্তিক। কৃষকরা প্রতিবছর ডুবে যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বোরো ফসল তোলে। কিন্তু এবার আর রক্ষা হলো না। ফসল হারিয়ে মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৌশলগত দিক বিবেচনা করে আমরা গজারিয়া খালে রাবার ড্যামটি নির্মাণ করেছি। ড্যামটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে আগে সরকারিভাবে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ করা হতো। কিন্তু পানির তোড়ে সেই বাঁধ ভেঙে যেত। পরে সেখানে এই ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আগাম বন্যা এলেও ড্যামের কারণে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় বোরো ফসলের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা নেই। মানুষ যাতে রাবার ড্যামের ওপর দিয়ে চলাচল না করে সে জন্য বিকল্প একটি সেতুও নির্মাণ করা হয়েছে।’ ৫০ মিটার দীর্ঘ ড্যাম ও সেতু নির্মাণে ২১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জসিম উদ্দিন বলেন, রাবার ড্যামটি উপজেলার কৃষকদের ব্যাপক উপকারে এসেছে। এ বছর আগাম বন্যা থেকে করছার হাওর রক্ষা পেয়েছে। দেশের অন্যান্য হাওরেও এ ধরনের ড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে।

ড্যাম নির্মাণের ঠিকাদার আজিজ কন্ট্রাক্টসের স্বত্বাধিকারী আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘সারা দেশে আমরা ৪৬টি রাবার ড্যাম নির্মাণ করেছি। রাবার ড্যাম দুইভাবে কাজে লাগে। প্রথমত, আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে ফসল রক্ষা পায়। দ্বিতীয়ত, গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি আটকে রেখে তা দিয়ে অন্য ফসল আবাদ করা যায়।’

উপজেলার কৃষক শাহেদ মিয়া ও আতাউর রহমান বলেন, ‘ড্যামটি আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। বোরো ধান তলিয়ে গেলে পথে বসতে হতো। তবে ড্যামের উচ্চতা আরো দুই ফুট বাড়ানো উচিত ছিল বলে অভিমত তাঁদের। কেননা বড় আকারে বন্যা হলে ড্যামটিও ডুবে যেতে পারে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ড্যামের উচ্চতা বাড়াতে গেলে অন্য জায়গায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর উচ্চতাও বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলায় বোরোর আবাদ হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। এই পরিমাণ জমি থেকে এবার তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদনের কথা জানিয়েছিল কৃষি বিভাগ।

জেলার কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক মীর বজলুর রশীদ বলেন, সুনামগঞ্জ জেলায় এ বছর দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়। সেখান থেকে আট লাখ ৮০ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু আগাম বন্যা ও শিলাবৃষ্টিতে ৪২ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ চার শ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। তবে কৃষক ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জানান, এবার দেড় লাখ হেক্টরের বেশি জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সে হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি।