সুভাষ সিংহ রায়
১৯৯৩ সালে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান একবার আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাত ধরে বলেছিলেন, ‘গাফ্ফার, দোহাই তোমার, হাসিনার সমালোচনা করো না। দীর্ঘকাল ধরেই তো চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, এত জ্ঞানী-গুণী, ডান-বামের বড় বড় নেতা। মুখে হাসিনার এত নিন্দা ও সমালোচনা। কিন্তু ক্রাইসিসের সময় হাসিনা ছাড়া তো কাউকে দেখি না।’ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে শেখ হাসিনাই পরিত্রাণকর্তা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তাঁর সভ্যতার সংকট’-এ লিখেছিলেন, ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে। অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যি সত্যি আমাদের লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আর্বজনাকে দূর করার জন্য টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়া গাঁয়ে জš§গ্রহণ করেছিলেন। মাত্র ১৩১৪ দিন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বাঙালি জাতিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর দেশের গণতন্ত্র ছিল অগণতান্ত্রিক শাসকদের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপে। এমন পরিস্থিতিতে সবাই আশা করত ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন সামরিক জান্তাকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু কোন বাংলাদেশকে পেছনে ত্যাগ করে যাবে? কে হবেন সেই পরিত্রাণকর্তা? নেতাজি সুভাষ বসু বলতেন, ‘আদর্শকে ষোলো আনা পাইতে হইলে নিজের ষোলো আনা দেয়া চাই।’ সেই ষোলো আনা দেয়ার মতো মানসিকতা সচরাচর মানুষের মধ্যে থাকবে না। অবশ্যই শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ষোলো আনা দেয়ার জন্য ৩৪ বছর আগে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিহাসের এক জটিল সময়ে তাকে জাতির পরিত্রাণকর্তার দায়িত্ব নিতে হয়।
পাঠকদের একটু ৩৫ বছর আগের কথা বলতে চাই। তখনো বাংলাদেশে এখনকার মতো প্রয়াত জিয়াউর রহমানের প্রবল প্রতাপশালীতার কথা কেউ বলতে চাইতেন না। এখনো বিষয়টা রেখে ঢেকে রাখতে চান। বেশ চমৎকার করে বলে থাকেন পেছনের কথা বলে কোনো লাভ নেই। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না এলে ক্ষমতার মদমত্ততার ও আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। এ কথা মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মান ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তার পথে পথে পাথর ছড়ানো ছিল। শুধু পাথর নয়, একপর্যায়ে দেখা গেল ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো।’ শেখ হাসিনা জেনে গিয়েছিলেন চলার পথে অনেক বাঁক থাকে, চোরাসে াত থাকে, অনির্দিষ্ট আর অলক্ষ অনেক উপাদানে জড়িয়ে থাকে ইতিহাসের অনির্ধারিত গতিপথে। অথচ শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৩ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কি তার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন? তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রথমক্ষণ পরিত্রাণকর্তার নাম শেখ হাসিনাথেকে জানতেন সংকটকালে সবচেয়ে বড় করে দেখা দেয় ‘ভরসার অভাব।’ অবিরাম সেই ভরসার পরিবেশ শেখ হাসিনা সৃষ্টি করে চলেছেন। সন্ত্রাস আর হিংসার উৎসভূমি তার কখনোই অজানা ছিল না, থাকার কথাও নয়। প্রাচীনকালে ‘অভয়প্রদান’কে সবচেয়ে বড় দান বলে বিবেচনা করা হতো। দিশেহারা বাঙালি জাতিকে তিনি সবসময় অভয় দিয়েছেন। এই জন্য নূর হোসেন শেখ হাসিনার ভরসায় বুকে পিঠে লিখে ফেলতে পেরেছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক।’ যে কারণে গফরগাঁওয়ের গরিব রিকশাওয়ালা হাসমত আলি শেখ হাসিনার জন্য জমি কিনে রেখে যান। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে এসেই তিনি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রামের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। কখনো কখনো আরো উন্নতর ভাবনার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছে। হোঁচটও খেয়েছেন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আগের সিদ্ধান্ত পরে নিয়েছেন। আবার অনেক পরের সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে ফেলেছেন। বিকল্প পথের চিন্তা তিনি সব সময় করে রাখেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঝুঁকিও নিয়েছেন। সততায় অবিচল থেকেছেন বলে বাংলাদেশকে একটি খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত করতে পেরেছেন। দেশকে তিনি যেমন শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর দাঁড় করিয়েছেন তেমনি সৃজনশীল কূটনীতি দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্র বিজয় করে এনেছেন। শেখ হাসিনাই ভারতের বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১০ হাজার একর জমি ফিরিয়ে এনেছেন, বিগত ৬৯ বছরে যা কেউ চিন্তাও করেননি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনাই পেরেছিলেন পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে। পৃথিবীতে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেও কেউ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন।
শেখ হাসিনা বোধহয় একমাত্র নেতা যিনি জীবনবোধের কথা বলতে গিয়ে অকপটে নিজেকে মেলে ধরেছেন। কোনো বাঁধাধরা তত্ত্বে নিজেকে তিনি আটকে রাখেননি। খোলা মনে, খোলা চোখে, শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে সবকিছু তিনি যাচাই করে দেখেছেন আর সেই সঙ্গে পুরনোকে ছাড়িয়ে নতুনের দিকে বাড়িয়েছেন তার হাত।
বিশেষত, বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতির পথ মসৃণ করতে হলে কী কী করতে হবে তা হাসিনাই বুঝেছেন। শিক্ষাকে দেশ বদলানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। মহামতি লেনিন বলেছিলেন, বিদ্যুৎ মানেই বিপ্লব। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সেই বিপ্লব ঘটিয়েছেন। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ আজ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। তার পারদর্শিতায় সব ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের অগ্রগতি হয়েছে। মাত্র ছ’বছরের মাথায় দেশের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলারে উন্নীত করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন, কিন্তু সমাজের কোনো কোনো বিজ্ঞজন সব সময় তাকে স্বীকৃতি দেননি। হয়তো তিনি এ কারণে বারবার কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু থেমে যাননি। দেশকে জঙ্গিবাদের রাহুগ্রাস থেকে বের করে এনে দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে সম্মানিত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়ক এতটা ঝুঁকি নেননি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতিসংঘের মহাসচিব যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে পারেননি। তারপরও প্রতিমুহূর্তে ঝুঁকির মধ্যে থাকা শেখ হাসিনার কদর অনেক খ্যাতিমানের কাছে নেই। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসনের দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসের দিনে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানব না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবোই করব।’ এমনকি যারা পক্ষের লোক বলে দাবি করেন তাদেরও অনেকেই নতুন প্রজšে§র কাছে শেখ হাসিনাকে যেভাবে তুলে ধরার কথা সেখানে তুলে ধরেন না। জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বিরামহীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের আবহাওয়া সৃজন এ সবই তাঁর একান্ত নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার ফসল। আজ দেশে-বিদেশে রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রাধান্যের কথা বলেন ও লেখেন। তিনি সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সব রাজনৈতিক আন্দোলন, তৎপরতা, প্রশংসা-নিন্দার লক্ষ্য এবং উপলক্ষ। বাংলাদেশে একটা প্রচলিত মতবাদ হলো বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকলে জনগণের জন্য করণীয় খুব একটা থাকে না। অথচ ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন সবসময়ই তিনি জনগণের কথা বলেছেন ও কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৬ মে) আগের দিন পত্রিকায় সংবাদ ছিল ‘শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি তাদের কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করেছে।’ বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিও বলে দেয় সেই প্রতিরোধ কমিটির কুশীলবরা এবং উত্তরসূরিরা এখনো সক্রিয়। ১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। শুধু ১৯৮১ সালে নয়, ২০০৭ সালে ৭ মে আবারো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তখনো কোনো ষড়যন্ত্র তার গতিপথ রুদ্ধ করতে পারেনি। সত্য যেখানে বিপজ্জনক সেখানে সত্যকে তিনি ভয় করেননি, মিথ্যা যেখানে সুবিধাজনক সেখানে তিনি সহায় করেননি মিথ্যাকে। আধুনিককালের চলমান পটের ওপর তিনি নিত্যকালের চিত্র রেখে যাচ্ছেন। প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’ শেখ হাসিনা পরিত্রাণকর্তা হয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ বাংলাদেশেতেই আছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব