২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিপি ১০৯২০০ কোটি টাকা অবকাঠামো ঘিরেই সব মনোযোগ

২০০৯ সালে প্রথম দফায় দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিটি বাজেটেই যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুতে বাড়তি টাকা না দিয়ে সরকার পুরোপুরি মনোযোগ দেয় অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে। এরই ধারাবাহিকতায় আসছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পরিবহন খাতকে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ জনগণের সামনে দৃশ্যমান দেখাতে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় পরিবহন খাতে ২৮ হাজার ৫০২ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা কমিশন, যা মোট এডিপির ২৬ শতাংশ। আসছে অর্থবছরে মোট এডিপির আকার এক লাখ ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা চূড়ান্ত করেছে কমিশন, যেটি অনুমোদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় উত্থাপন করা হবে। রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন।

পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন থেকে পাঁচ বছর আগে দেশে বিদ্যুতের তীব্র সংকট ছিল। তখন বিদ্যুতের চাহিদার কথা বিবেচনা করে এ খাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে গত পাঁচ বছরে বিদ্যুতের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তাই এ খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ না বাড়িয়ে পরিবহনে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন সহজ হয়। ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কোনো ঝামেলা ছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া যায়। দেশে যেহেতু এ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা হরতাল-অবরোধ নেই, তাই এ সময়ে বড় বড় প্রকল্পগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে চায় সরকার। আগামী বছর হবে সরকারের তৃতীয় বাজেট। বছরের পুরোটা সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়া কেটে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পরের বছর থেকে শুরু হবে ভোটের হিসাব-নিকাশ। সে জন্য সড়ক পরিবহন, রেল, নৌসহ অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে সরকারের সব মনোযোগ বলে জানান কর্মকর্তারা।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে গত সপ্তাহে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার থাকবে পরিবহন খাতে। পরিবহন খাতের বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ আমরা দ্রুত শেষ করতে চাই।’ কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশের সুষম উন্নয়ন, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, জনগণের আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অবকাঠামোতে বাড়তি টাকা দেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, দেশের ১৯ জেলার মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ এখন পর্যন্ত ৩৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। আসছে বাজেটে পদ্মা সেতুর কাজ আরো দ্রুত এগিয়ে নিতে ছয় হাজার ২৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে পদ্মা সেতুতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। সে হিসাবে সেতুতে বাজেট বেড়েছে দ্বিগুণ। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলের জন্য রাখা হয়েছে দুই হাজার ২২৬ কোটি টাকা। কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণের জন্য আসছে বাজেটে দুই হাজার কোটি টাকা, রাজধানী ঢাকায় এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু করতে রাখা হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ করতে আসছে বছরের বাজেটে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, কাঁচপুর, গোমতী, মেঘনা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সরকার চায় এসব প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে উত্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন এডিপির যে খসড়া তৈরি করেছে তাতে দেখা গেছে এডিপিতে মোট এক লাখ ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির ১৩ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির ২০ শতাংশ বেশি। এক লাখ ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হয়েছে ৬৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর বাকি ৪০ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার আশা করছে সরকার।

আগামী অর্থবছরের এডিপিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পাওয়া পরিবহনে দেওয়া হয়েছে মোট বরাদ্দের ২৬ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাকা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও ধর্ম খাতে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (তিন) আওতায় সারা দেশে নতুন স্কুল নির্মাণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তির জন্য সরকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাকা শিক্ষাতে দিতে চায়। আসছে বাজেটে উপবৃত্তি বাবদ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করবে সরকার। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের ১৩ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ এবং গৃহায়ণ খাত। আগামী বাজেটে এডিপিতে এ খাতে ১২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ টাকা রাখা হয়েছে। গত ছয় বছর ধরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিদ্যুৎ খাত এবার চলে গেছে চতুর্থতে। আসছে বাজেটে এ খাতে রাখা হয়েছে ১২ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ১১.৫১ শতাংশ।

এদিকে আগামী অর্থবছরের এডিপি থেকে ২৬টি প্রকল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, যেসব প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো নয়, সেগুলো এডিপি থেকে বাদ দেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর প্রথমবারের মতো ২৬টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন সমস্যার কারণে স্থবির হয়ে আছে। প্রস্তাবটি আজ এনইসি সভায় অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রয়েছে। এ ছাড়া ৩৪টি প্রকল্প বিশেষ বিবেচনায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের এডিপি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য যে ২৬টি প্রকল্প বাছাই করেছে কমিশন সেগুলোর অনেক প্রকল্পই ২০০০ সালের। যা গত ১৬ বছরেও শেষ হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন আয়োডিনযুক্ত লবণ তৈরি কার্যক্রমের মাধ্যমে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ। এই প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে। এখনো শেষ হয়নি। পাবনা বিসিক শিল্পনগরী, বিএসটিআই আধুনিকায়ন, পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প রয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এটি ২০০২ সালে শুরু হয়। এখনো শেষ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বেশি টাকা বরাদ্দ পাওয়া অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রেলপথ। মন্ত্রণালয়ের পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের কাজ শুরু করতে এবং ২০১৮ সালেই পদ্মা সেতুর সঙ্গে একসঙ্গে উদ্বোধন করতে এই প্রকল্পে চার হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। আর বিদ্যুতে মাতারবাড়িতে দুই হাজার ৪০০ কোটি দেওয়া হয়েছে।