চট্টগ্রামের মীরসরাই এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রযুক্তিভিত্তিক (আইটি) দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে ৯ কোটি ডলার বা ৭০২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এ টাকা দিয়ে সরকার আইটি পার্কের জন্য ভূমি উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে খরচ করবে।
দিনব্যাপী ওই বৈঠকে বাংলাদেশের আট সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী সদস্য ও অতিরিক্ত সচিব এস এম শওকত আলী। আর ভারতের আট সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুপ্রিয়া রঙ্গনাথ। এর আগে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা এবং বাগেরহাটের মংলায় ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সেখানকার অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশকে ৮.৮ কোটি ডলার বা ৮৮৬ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল দেশটি। দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসির আওতায় সব মিলিয়ে ১৭.৮ কোটি ডলার বা এক হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে ভারতের।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন করে সেই পণ্য সেভেন সিস্টার্স খ্যাত সাতটি অঙ্গরাজ্যে (আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও অরুণাচল) কম খরচে নিয়ে যেতে দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ জানিয়ে আসছিল ভারত। গত বছর জুনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে বাগেরহাটের মংলায় এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়। ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সরকার এরই মধ্যে ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর পাশে ৪০৭ একর এবং বাগেরহাটের মংলায় ১১০ একর জমি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। সেখানকার প্রাথমিক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও চলছে। কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চল দুটি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, কিংবা সেখানে দুই দেশের কার কী পরিমাণ শেয়ার থাকবে সে বিষয়ে মোদির সফরে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মোদির সফরের প্রায় এক বছরের মাথায় অবশেষে গতকাল দুই দেশের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে গত ২২ মার্চ এ বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে পরে তা বাতিল করা হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি বেজার নির্বাহী সদস্য এস এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য তাদের কাছে ৯ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছি। তারা সেই ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল কিভাবে পরিচালিত হবে, বা কবে নাগাদ তারা সমীক্ষার কাজ শেষ করবে এসব বিষয়েও দুই পক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে আবারও বৈঠক হবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশে কোন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়তে ভারত আগ্রহী—এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম শওকত আলী বলেন, ‘সেটি এখনই জানা যাবে না। তারা সমীক্ষা করে দেখবে সেখানে কোন ধরনের শিল্প-কারখানা নির্মাণ করলে সেটি যৌক্তিক হবে। সমীক্ষার পরই তা জানা যাবে। তার আগে নয়।’
গতকালের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রামের মীরসরাই এবং ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জে আইটিভিত্তিক দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু সে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক টাকার প্রয়োজন। এর মধ্যে ৯ কোটি ডলার বা ৭০২ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে গত মাসে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ভারতের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আইটিভিত্তিক দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দেশটির পক্ষ থেকে বৈঠকে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা হয়। বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধিরা বলেন, দেশে গিয়ে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আলোচনা করবেন এবং ইতিবাচক সাড়া আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কার কত শতাংশ শেয়ার থাকবে—এ বিষয়েও গতকালের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, সরকারের সামনে চীন ও জাপানের দুটি উদাহরণ আছে। এর আগে চীনের জন্য আনোয়ারা এবং জাপানের জন্য গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য স্থান চূড়ান্ত হয়েছে। সেসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীন ও জাপানের শেয়ার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ইক্যুইটি থাকবে ৩০ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রেও একই ইক্যুইটি হতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে দুই পক্ষই ঐকমত্য পোষণ করেছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
ভারত কবে নাগাদ ভেড়ামারা ও মংলায় তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু করবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে দেশটির প্রতিনিধিরা বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে তারা ডেভেলপার নিয়োগ দেবে। নিয়োগ পাওয়া ডেভেলপার আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিস্তারিত সমীক্ষার কাজ শেষ করবে। সেখানে পরিবেশগত ছাড়পত্র, বিস্তারিত নকশা, আর্থিক ও কারিগরি বিশ্লেষণ এবং ওই দুই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কী ধরনের ব্যবসা এবং শিল্প-কারখানা করা যায়, এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সমীক্ষা করা হবে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সমীক্ষার কাজ শেষ হবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
এ সময় ভারতের প্রতিনিধিদল ভেড়ামারা ও মংলায় তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, শুধু ভেড়ামারা ও মংলার জন্য নয়, বাংলাদেশে যতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, সবকটিতেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশে পুলিশ ফাঁড়ি কিংবা পুলিশ ও বিজিবির সার্বক্ষণিক টহল থাকবে। পাশাপাশি ডেভেলপারের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাব্যবস্থা তো থাকবেই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে কোনো দেশ বিনিয়োগ করলে তাদের জন্য কর অবকাশ সুবিধা, সব ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা, আয়করমুক্তসহ একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করে রেখেছে বেজা। গতকালের সভায় সেসব প্রণোদনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, যদি ভারতের বড় কোনো বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে আরো কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, সেসব বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করবে।
বেজা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীন যেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে, সেখানকার অবকাঠামো উন্নয়নে দেশটি বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই ১০ কোটি ডলার দিয়ে সেখানকার প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। জাপানও তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক কাজের জন্য সরকারকে অনুদান দিয়েছে। সরকারের প্রত্যাশা ছিল ভারতও অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অনুদান দেবে। কিন্তু সরকারের সে আশা পূরণ হয়নি। ভারত সরকার যে টাকা দেবে সেটি অনুদান নয় ঋণ। দ্বিতীয় দফায় তারা বাংলাদেশকে যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, সেই ঋণের আওতায় এই দেড় হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। এই ঋণের সুদের হার হবে ১ শতাংশ। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে বাংলাদেশ এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। গ্রেস পিরিয়ডের সময় সুদ গুনতে হবে না। এরপর থেকে মূল টাকার পাশাপাশি সুদ পরিশোধ শুরু করতে হবে। এ ঋণে কমিটমেন্ট ফি ধরা হয়েছে .৫০ শতাংশ। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ২০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে গত মার্চে। এ ২০০ কোটি ডলার ঋণের আওতায় মোট ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, যার মধ্যে দুই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি রয়েছে। এ ছাড়া বাকি দুটি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হবে শিগগিরই।