বদলে যাচ্ছে গ্রাম জনসংখ্যার ৭২ ভাগের বাস এখানে

শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে দেশের গ্রামীণ চিত্রও। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বলতে গেলে ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে গেছে। কৃষি, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে গ্রামীণ উদ্যোক্তা। এই প্রতিযোগিতায় পুরুষের সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও। বাড়ছে স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যা। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বদলে গেছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানও।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৯০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে গ্রাম। মোট জনসংখ্যার অন্তত ৭২ শতাংশ এখনও গ্রামে বসবাস করছেন। গ্রাম ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নে বিগত সবগুলো সরকারই কম-বেশি ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমান সরকারের গত ৭ বছরে (২০০৯ সাল থেকে) গ্রাম উন্নয়নে তুলনামূলক বরাদ্দ বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, গ্রামীণ সড়কে ব্রিজ-কালভার্ট, গ্রোথসেন্টার-হাটবাজার উন্নয়ন, উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণ-সম্প্রসারণ, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও পুনর্বাসন, মাটির রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, বাঁধ নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ, পানি নিয়ন্ত্রক অবকাঠামো (স্লুইস গেট), রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং খাল খনন ও পুনঃখননসহ গ্রামে একধরনের কর্মযজ্ঞ চলছে। যোগাযোগের উন্নয়ন হওয়ায় কৃষিখাতে উন্নয়ন বৃদ্ধি ও সহজ বিপণনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রসহ সহায়ক অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও কাঙ্ক্ষিত সফলতা এসেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সুপেয় নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য-শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। যেখানে ২০০০ সালে পানি সরবরাহ কভারেজ ছিল ৭৪ শতাংশ, সেটির বর্তমান হার ৮৮ শতাংশ। ২০০৩ সালে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের হার ছিল ৪২ শতাংশ, যা বর্তমানে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের অগ্রগতির মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবেশের যেমন উন্নতি ঘটছে, একইভাবে পানিবাহিত রোগবালাইও কমছে।

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকারমলূক ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলায় ৪৮৫টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৯৩টি ইউনিয়নের সকল ওয়ার্ডে ১টি করে মোট ৪০ হাজার ৫২৭টি গ্রামের প্রায় ২২ লাখ দরিদ্র পরিবার তথা ১ কোটির বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। প্রকল্পভুক্ত দরিদ্র উপকারভোগীদের বর্তমান মূলধন প্রায় ২ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে তাদের নিজস্ব সঞ্চয় ৯২৭ কোটি টাকা এবং সরকারি অনুদান ১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এর সাথে ব্যাংক সুদ, সার্ভিস চার্জ ইত্যাদি যুক্ত হয়ে ২ হাজার ৭১৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এই অর্থের পুরোটাই দরিদ্র জনগণের সমিতির ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত রয়েছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সমিতির সদস্যরা ওই তহবিল থেকে প্রায় ২ হাজার ৭শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২২ লাখ ৮০ হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়বর্ধক খামার গড়ে তুলেছেন। এই প্রকল্পভুক্ত প্রতিটি পরিবারের বছরে গড় আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৯২১ টাকা। প্রকল্প এলাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারের সংখ্যা ১৫ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে এসেছে। একইসঙ্গে অধিক আয়ের পরিবারের সংখ্যা ২৩ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ৩১ শতাংশ হয়েছে।

এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রাম ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় উপজেলা উন্নয়ন সহায়তা খাত থেকে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৪৮৯টি উপজেলা পরিষদের অনুকূলে জনসংখ্যা, আয়তন ও অনগ্রসরতা বিবেচনায় ৪৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জানান, ২০১১-১৬ মেয়াদে ‘দ্বিতীয় লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি-২)’ বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সুব্যবস্থাসহ কৃষি উন্নয়নে সেচ ব্যবস্থায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ‘ইত্তেফাক’কে জানান, সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ‘গারো সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’ ও ‘সমবায় ভিত্তিক দুগ্ধ উত্পাদন নিশ্চিতকরণ’ নামে দুইটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ‘দুগ্ধ সমবায় সমিতির কার্যক্রম বিস্মৃতকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটিও বাস্তবায়নাধীন। পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) গৃহীত ‘গ্রামীণ নারীর বীজ ব্যবসা’ প্রকল্পের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ১ হাজার ২৫০ জন নারী বীজ ব্যবসায়ী স্বাবলম্বী হয়েছেন। ‘এম-ফোর-সি’ প্রকল্পের আওতায় উত্তরাঞ্চলের ১০টি জেলার চর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য গ্রুপ তৈরি এবং কৃষি উন্নয়ন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৬০ হাজার পরিবারের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি আরডিএ-এর। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে।