‘জয়িতা তোমরাই বাংলাদেশের বাতিঘর’

শ্রেষ্ঠ পাঁচ জয়িতাকে সংবর্ধনা

বাল্য বিয়ে দিয়ে জীবনের বৈষম্যের শুরু। বিয়ের পরই স্বামী তাকে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। সেখানে নিজের বিভীষিকাময় জীবনের পরেও ভাবিয়ে তোলে পতিতাপল্লীর ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের অবস্থার কথা। সমাজের রক্তচক্ষু, ঘৃণা আর একঘরে জীবনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তি মহিলা সংস্থা’ নামক এনজিও। যেখানে বর্তমানে ২০৮ শিশুর শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন রাজবাড়ী জেলার মর্জিনা বেগম।

 

শৈশবে অন্য ছেলে শিশুদের মত আনন্দে দিন কাটলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মে বুঝতে পারেন তার আচরণ মেয়েদের মতো। মেয়েলী আচরণের জন্য পরিবারে ও সমাজে তাকে প্রতিমুহূর্তে লাঞ্ছিত হতে হয়। অনেকে তাকে ‘এই হিজড়া এদিকে আয়’ বলে তাচ্ছিল্য করত। এভাবেই শুরু হয় জীবনের সংগ্রাম। নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে লেখাপড়া শেষ করে কাজ শুরু করেন এনজিওতে। ২০১৩ সালে ‘সিঁড়ি’ নামে একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা নামক হিজড়াদের নিয়ে সংগঠন গড়ে  তোলেন। সমাজে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি জামালপুর জেলার আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী।

 

এরকম ব্যতিক্রম কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘জয়িতা তোমরাই বাংলাদেশের বাতিঘর’ শিরোনামে পাঁচ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ ৫ জয়িতাকে  সংবর্ধনা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় ভাবে বাছাই করে শ্রেষ্ঠ পাঁচ ও রানারআপ পাঁচ হিসেবে মোট ১০জন নারীকে ক্রেষ্ট, উত্তরীয়, সার্টিফিকেট ও চেক প্রদান করে সম্মাননা জানানো হয়। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল বুধবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

 

অনুষ্ঠানের শুরুতে ১০ সফল নারীর জীবন সংগ্রামের উপর ধারণকৃত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্য থেকে বিচারকরা ৫ সফল নারীকে নম্বরের ভিত্তিতে বাছাই করেন।

 

পাঁচ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ নারীরা হচ্ছেন— অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ নারী রাজিয়া বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু ক্যাটাগরিতে প্রথম মর্জিনা বেগম, সফল জননী ক্যাটাগরিতে সেলিনা আমীন, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী  ক্যাটাগরিতে ড. শাহিদা আক্তার। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য সফল নারী ক্যাটাগরিতে আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী।

 

রানারআপ হয়েছেন- অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী হিসেবে মমতাজ বেগম শোভা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু ক্যাটাগরিতে আমেনা বেগম, সফল জননী ক্যাটাগরিতে মনোয়ারা বেগম, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী ক্যাটাগরিতে অধ্যাপক ড. শিরিন বেগম। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য মাজেদা বেগম।

 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, শতবাধা অতিক্রম করে যে নারীরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন সেই সব বিজয়ী নারীর জন্য আজকের অনুষ্ঠান। জন্ম থেকেই নারীদের অনেক প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে আসতে হয়। তবে আজকের এই নারীরা হবে দেশের অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা। প্রধানমন্ত্রী নারীদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত করতেই এই ‘জয়িতা’র সূচনা করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় নারীরা বিভিন্ন উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিতে হলে নারীদের উন্নয়ন করতে হবে। নারীদের উন্নয়ন করতে হলে, তাদের আর্থিক, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন নারীদের শিক্ষা অর্জন করা। সে ক্ষেত্রেও কাজ করছে সরকার। নারীদের দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

 

দেশের প্রতি বিভাগ থেকে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই কার্যক্রম চালু করেছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় থেকে বাছাইকৃত ৮৩ নারীর মধ্য থেকে ১০জন সফল নারীকে বেছে তুলে আনার কাজটি করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম (এনডিসি), মহিলা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহিন আহমেদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিভাগের কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক বেগম জিনাত আরা।

 

জয়িতা ফাউন্ডেশনকে জমি প্রদান

 

জয়িতা ফাউন্ডেশনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালী করে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখতে সক্ষম একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ঢাকা শহরের ধানমন্ডি ২৭ নং রোডে প্রায় এক বিঘা জমিসহ একটি একতলা ভবনের মালিকানা প্রদান করা হয়েছে। এ জমিতে সরকারের আর্থিক সহায়তায় তিনটি বেজমেন্টসহ ১৪ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ভবনে নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত জয়িতা বিপণন কেন্দ্র, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ সুবিধা, হোস্টেল সুবিধা, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও জয়িতা ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে।

 

গতকাল বুধবার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও জয়িতা ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস এর চেয়ারপার্সন মেহের আফরোজ চুমকি-এর নিকট জয়িতা ফাউন্ডেশনকে প্রদত্ত জমির মালিকানা ও দখল সংক্রান্ত দলিল হস্তান্তর করেন।