বাংলাদেশে গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। নতুন ক্ষেত্র পাওয়া না গেলে বর্তমান মজুদ দিয়ে বড়জোর আর ১০ থেকে ১২ বছর চলতে পারে—জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগসহ সরকার সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে এ কথাই বলে আসছে। আর এ খবরে শিল্পোদ্যোক্তাসহ সাধারণ মানুষের দুর্ভাবনা বাড়ছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশের সাগর সীমানায় বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ আছে। আর স্থলভাগে যেসব পকেট গ্যাস পাওয়া যাবে তা দিয়ে নিশ্চিন্তে আরো বহু বছর চালানো যাবে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়ার কিছু নেই।
দেশে এ পর্যন্ত মোট ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে, যার মধ্যে ২০টি থেকে তোলা হচ্ছে এ অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাধীনতার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস। ২৭ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন মজুদের মধ্যে উত্তোলনযোগ্য ১৩ দশমিক ৬৪ টিসিএফ। প্রতিবছর ৮০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস খরচ হচ্ছে। এ হারে চলতে থাকলে ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুদ শেষ হবে। তবে আশার কথা হলো, সম্প্রতি সমুদ্র ও স্থলভাগে বড় দুটি গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। এর একটির অবস্থান অগভীর সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকে, অন্যটি ভোলার শাহবাজপুরে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রের ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর ব্লক তিনটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে সরকার গ্যাসের মজুদের ওপর ভরসা করে বসে নেই। জ্বালানি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য গ্যাসের বিকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে জ্বালানি বিভাগ। আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ আর দেওয়া হবে না। এ খাতে এলপিজি ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি নিরুৎসাহিত করতে দাম বাড়ানো এবং পেট্রল ও অকটেনের দাম কমানোর একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিদিন এ টার্মিনাল থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসনির্ভর। এবার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের রিলায়েন্সের একটি প্রস্তাবের ওপর সমীক্ষা চলছে। এ ছাড়া বেশ কিছু এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তা রয়েছে সরকারের। বেসরকারি খাতে এলএনজি ও সিএনজি আমদানি বিষয়ে একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করছে সরকার।
গ্যাসের মজুদ সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মজুদ বাড়ছে এটি সত্য। কিন্তু একই সঙ্গে চাহিদাও বাড়ছে। এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। আমরা একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছি, যাতে জ্বালানি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা যায়।’
নসরুল হামিদ আরো বলেন, নিজেদের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপরই আমরা শুধু নির্ভর করছি না। এলপিজির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে, এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। আমাদের দেশে যে ব্যাপক শিল্পায়ন ও উন্নয়ন হচ্ছে—সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্রের ১১ নম্বর ব্লকে গ্যাস পাওয়া গেছে। তবে মজুদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সেখানে ত্রিমাত্রিক জরিপ শেষে কূপ খনন করতে হবে। এ ক্ষেত্রটি মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী। ওই ব্লকে ক্রিস এনার্জি ও সান্টোস কাজ করছে। সেখানে দ্বিমাত্রিক জরিপ শেষে তারা গ্যাস পাওয়ার কথা জ্বালানি বিভাগকে জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ব্লকে বড় ধরনের মজুদ আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে গভীর ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেয়। এরই অংশ হিসেবে গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক দুটি ইজারা দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কম্পানি কনোকো ফিলিপসকে। গত বছর তারা এই দুই ব্লকে সাত টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ঘোষণাও দেয়। তবে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস আট ডলার দাবি করে কম্পানিটি। নতুবা এ গ্যাস বিদেশে রপ্তানির সুযোগ চায় তারা। চুক্তির তিন বছর পর এ ধরনের আবদার সরকার মেনে না নেওয়ায় কম্পানিটি দেশ ছেড়ে চলে যায়। এরপর থেকে ব্লক দুটি ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া থেমে আছে। ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে যে সাত টিসিএফ গ্যাস রয়েছে তা বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য মজুদের অর্ধেকের বেশি।
স্থলভাগেও মিলছে বড় মজুদ : দক্ষিণের জেলা ভোলার শাহবাজপুরে গ্যাসের বড় মজুদ মিলেছে। এ ক্ষেত্রটিতে ৬৬৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানানো হয়েছে। তবে এ মজুদ বেড়ে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটেরও বেশি হতে পারে। বর্তমানে সেখানে চারটি কূপ রয়েছে। এর মধ্যে দুটির সংস্কার (ওয়ার্কওভার) করতে হবে। এরপর সেখানে দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কম্পানি (বাপেক্স) ত্রিমাত্রিক জরিপ করে গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত করেছে। সেখানে খননযন্ত্র (রিগ) নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রেও মজুদের পরিমাণ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রটিতেও কাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাপেক্স।
জানা গেছে, পেট্রোবাংলা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের যৌথ জরিপে দেশের স্থলভাগে ৪২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়ে সরকারের আরেকটি যৌথ জরিপেও একই সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের স্থলভাগে বেশ কিছু পকেট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো থেকে আঞ্চলিকভাবে শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
ভোলার গ্যাসে জেগে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল : ভোলার গ্যাস ব্যবহার করে বর্তমানে সেখানে ২২৫ ও ৩৫ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে। এ ছাড়া সেখানকার শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদেরও গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রটির মজুদ বাড়লে তা বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সাশ্রয়ী জ্বালানির অভাবে খুলনার কারখানাগুলো ধুঁকছে। নতুন কোনো বিনিয়োগ সেখানে হয়নি। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও একই অবস্থা। ভোলায় বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারে। এতে করে পায়রা ও মংলা বন্দরও গতি পাবে।