সবুজ পৃথিবী

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

বনে ঘুরছেন। হঠাৎ যদি সামনে আসে উল্লুক কিংবা বানর। দূর থেকে হয়তো দেখলেন বিলুপ্তপ্রায় মায়া হরিণের মুখ। নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার হবে। যদি সেটি হয় দুর্লভ আরো অনেক প্রাণীর সঙ্গে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। দেশের ভেতরে এমন জায়গা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।

এই উদ্যানের বেশির ভাগ গাছপালা চিরসবুজ। একই সঙ্গে এটি বৃষ্টিবন বা রেইন ফরেস্ট। সারা বছর এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। উদ্যানের গাছগুলো অনেক উঁচু।

স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাউয়াছড়া উদ্যানের পুরনো নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ব্রিটিশ সরকার ১৯২৫ সালের দিকে প্রথম এ অঞ্চলে বৃক্ষায়ণ শুরু করে। এসব গাছপালা বেড়ে বনের সৃষ্টি হয়। দুই উপজেলার প্রায় দুই হাজার ৭৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এর প্রায় এক হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি স্থানীয় গাইড শফিকুল ইসলাম বন ঘুরে দেখানোর সময় জানান, সেখানে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্য প্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর অন্যতম আকর্ষণ বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক। গভীর জঙ্গলের উঁচু ডালে এরা পরিবারসহ বসবাস করে। জীববৈচিত্র্য গবেষণা থেকে জানা যায়, উল্লুক মূলত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বন মানুষ।

এ ছাড়া চশমা বানর, মুখপোড়া হনুমান, আসামি বানর, লজ্জাবতী বানর, মেছোবাঘ, শিয়াল, মায়া হরিণ ইত্যাদি দেখা যায় এ বনে। এখানে আরো আছে অজগরসহ নানা রকম বিষাক্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সাপ। এ ছাড়া হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও এ বনের উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ। পাখিদের মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, হরিয়াল, তুর্কিবাজ, কালো মাথা টিয়া, লেজকাটা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, কালো বাজ, হীরামন, কালো মাথা বুলবুল, ধুমকল, প্যাঁচা, ফিঙ্গে, সবুজ সুইচোরা, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা, কেশরাজ ইত্যাদি।

উদ্যানের ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—গর্জন, সেগুন, গামার, জামরুল, চাপালিশ, মেনজিয়াম, নাগেশ্বর, শিমুল, লোহাকাঠ, জাম, ডুমুর, তুন, কড়ই, জগডুমুর, মুলিবাঁশ ইত্যাদি। এ ছাড়া এ বনে আছে নানা প্রজাতির অর্কিড। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আরো আছে চশমা পরা হনুমান। বাংলাদেশের তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে চশমা পরা হনুমান আকারে সবচেয়ে ছোট।

বনের বিভিন্ন দুর্গম পথ ঘুরে দেখা গেছে, উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে এই উদ্যানের গঠন। পাহাড়ি টিলার মাঝেমধ্যে এই বনের চলার পথ। এখানকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। তবে এসব ছড়ার বেশির ভাগ পানিতে পূর্ণ থাকে বর্ষাকালে। সামান্য যে কটি ছড়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে, সেসব এলাকায় বন্য প্রাণীদের আনাগোনা বেশি। প্রধান সড়ক ফেলে কিছু দূর চলার পর ভেতর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন। এর পরই মূলত জঙ্গলের শুরু। মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলে সাইরেনের মতো এক ধরনের শব্দ কানে আসে। এটি মূলত ঝিঁঝি পোকার ডাক। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি পথ আছে। একটি তিন ঘণ্টার, একটি এক ঘণ্টার এবং অন্যটি আধাঘণ্টার পথ। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়া পল্লী আছে। সেখানে ১৭টি পরিবারের শতাধিক মানুষ বাস করে। তাদের জীবিকার মূল মাধ্যম হলো পান চাষ ও ফলমূল বিক্রি।

কথা হয় খাসিয়া যুবক মুরং ফুলিংয়ের সঙ্গে। তিনি জানান, খাসিয়ারা পান চাষনির্ভর। শ্রীমঙ্গলের আসাম সীমান্তের খাসি-হিলে দেখা মেলে এমন নিবিড় পান জুমের। সমতলের পান চাষের চেয়ে এটা ভিন্ন। পান জুমের পাতাগুলো আকারে ছোট, এগুলো বেশ ঝাঁজালো স্বাদের। দেশ-বিদেশে পানপ্রিয়দের কাছে খাসিয়া পানপাতার বিশেষ কদর রয়েছে।

আদিবাসী যুবক রেয়াং টম ডায়ার বলেন, ‘খাসিয়াদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, আচার ও ঐতিহ্য। অধিকাংশ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হলেও আদি ধর্ম প্রকৃতি পূজার বেশ কিছু বিশ্বাস এখনো পালন করি আমরা।’

খাসিয়া পান ব্যবসায়ী বিস্মৃত জানান, একই পাহাড়, অরণ্য ও টিলায় বংশপরম্পরায় বসবাস করলেও তাঁদের নেই জমির ওপর মালিকানা। তাই বন বিভাগ ও চা বাগান মালিকসহ নানা ধরনের উচ্ছেদ আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাঁদের তাড়া করে ফেরে। স্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়ার বিষয়ে সরকারি দপ্তরে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও কোনো ফল মেলেনি। খাসি পুঞ্জিগুলোতে নেই শিক্ষা, চিকিৎসা, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ও বিদ্যুৎ সুবিধা।

এই বনে এক ঘণ্টার হাঁটা পথে দেখা মেলে বিশাল গন্ধরুই গাছ, যার আরেক নাম কস্তুরী। এ গাছ থেকে সুগন্ধি তৈরি হয়। আরো দেখা যায় ঝাওয়া, জগডুমুর, মুলিবাঁশ, কাঠালিচাঁপা, লেহা ইত্যাদি গাছ। আরো আছে প্রায় শ বছরের পুরনো চাপালিশ ও গামারি গাছ। পথের পাশে থাকা ডুমুরগাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর ও হনুমান। এখানে দেখা মেলে মায়া হরিণ ও বনমোরগের।

বন ভ্রমণের জন্য ১২ জন গাইড রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে তাদের কাছে নেই কোনো অস্ত্রের ব্যবস্থা। নারীদের শৌচাগারের কোনো সুব্যবস্থা নেই। অথচ প্রতিদিন দেশি-বিদেশি মিলে কয়েক শ পর্যটক দেখতে আসে এই বন।

লাউয়াছড়ার বন কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব বলেন, ‘পর্যটকদের নির্বিঘ্নে চলাচল ও অবস্থানে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা হলে এটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।’