পাখির মতো আকাশে ওড়ার ইচ্ছা পূরণ

সেনাবাহিনীর প্রথম দুই নারী বৈমানিক

বৈমানিক হবেন এমন স্বপ্ন কি কখনো ছিল—এ প্রশ্নে ওঁরা কয়েক মুহূর্ত নিরুত্তর। হয়তো শৈশবের স্মৃতি হাতড়ালেন। এরপর প্রায় অভিন্ন জবাব মিলল। মেজর নাজিয়া নুসরাত হোসেন বললেন, ‘পাখিদের দেখে কার না সাধ জাগে মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়াতে। সেনাবাহিনী আমাকে সে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দিয়েছে।’ আর মেজর শাহরীনা বিনতে আনোয়ার বললেন, ‘পাখিদের দেখেই তো একসময় মানুষ আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছে। শৈশবে কাগজের প্লেন বানাতাম। আকাশে ওড়াতাম। কিন্তু সত্যিকারের প্লেনের চালক হতে পারব তা সে সময় ভাবিনি। অবশ্য আমি বৈমানিক হয়েছি আমার ইচ্ছাতেই। পরিবার উৎসাহ জুগিয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুযোগ দিয়েছে। আসলে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি অনেক কিছুই সম্ভব করে তোলে।’

এভিয়েশন বেসিক কোর্স-৯-এর ফ্লাইং ব্রেভেট প্রদান অনুষ্ঠান শেষে গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে এসব কথা বলেন নাজিয়া ও শাহরীনা। ঢাকা সেনানিবাসের অ্যাডহক আর্মি এভিয়েশন গ্রুপে আয়েজিত এ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক প্রধান অতিথি হিসেবে এই দুই নারীসহ ১২ জন নবীন বৈমানিককে ফ্লাইং ব্রেভেট পরিয়ে দেন। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুই নারী অফিসার বৈমানিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। এ কোর্সে মেজর মো. শামীম ফেরদৌস শ্রেষ্ঠ বৈমানিক নির্বাচিত হন। নাজিয়া ও শাহরীনা যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম স্থান লাভ করেন।

মেজর নাজিয়া এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের মেয়ে। বাবা মো. মোশাররফ হোসেন ও মা লায়লা আক্তার বানুর প্রথম সন্তান। পড়াশোনা করেছেন মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। যুগ্ম সচিব বাবা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত। ছোট ভাই এআইইউবিতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। নাজিয়ার স্বামী মেজর মাহমুদুর রহমান (ইঞ্জিনিয়ার্স) সেনাবাহিনীতে কর্মরত।

শাহরীনা জানান, তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরায়। বাবা মো. আনোয়ারুল হকের চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা রয়েছে। মায়ের নাম আরজুমা আনোয়ার। মা-বাবার একমাত্র সন্তান শাহরীনার পড়াশোনা সাতক্ষীরা গার্লস হাই স্কুল ও যশোর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বিয়ে করেছেন বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার খালিদুর রহমানকে।

এর আগে প্রশিক্ষণ চলাকালে গত বছর জুনে এই দুই নারী সেনা কর্মকর্তা ঢাকার তেজগাঁওয়ের আর্মি এভিয়েশন গ্রুপে সফলভাবে একক ও দ্বৈত উড্ডয়ন পরিচালনা করেন। তাঁরা সেনাবাহিনীর সেসনা ১৫২ এরোপেক প্রশিক্ষণ বিমানের মাধ্যমে এ উড্ডয়ন পরিচলনা করেন। দীর্ঘ এই প্রশিক্ষণের সময় সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কী ছিল—এ প্রশ্নে নাজিয়া ও শাহরীনা জানালেন তাঁদের ওই একক উড্ডয়নের কথা। সে অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।

দেশে এর আগে সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিমানবাহিনীর দুজন নারী কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই-লুিফ বেল-২০৬ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে প্রথমবারের মতো নারী বৈমানিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

এদিকে সেনাবাহিনীর এই দুজন নারী বৈমানিকের মধ্যে ক্যাপ্টেন নাজিয়া নুসরাত হোসেন সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৬১তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। ইঞ্জিনিয়ার্স কোরের সব আবশ্যক কোর্স সম্পন্ন করে তিনি গত বছর ১৬ নভেম্বর আর্মি এভিয়েশন বেসিক কোর্স-৯-এ যোগ দেন। এরপর গত ১৮ জুন তিনি তাঁর উড্ডয়ন দক্ষতা প্রমাণ করতে প্রথম একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেন। অন্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন শাহরীনা বিনতে আনোয়ারও প্রায় ছয় বছর আগে একই সময়ে ৬১তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে কমিশন লাভ করেন। অর্ডন্যান্স কোরের সব আবশ্যক কোর্স সম্পন্ন করে ক্যাপ্টেন নাজিয়া নুসরাত হোসেনের সঙ্গে তিনিও আর্মি এভিয়েশন বেসিক কোর্স-৯-এ যোগ দেন এবং গত ৩০ জুন প্রথম একক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেন।

প্রসঙ্গত, আর্মি এভিয়েশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি বিপুলসংখ্যক সেনা পাইলটকে প্রশিক্ষিত করেছে গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থা। এত দিন এখানে শুধু পুরুষ পাইলটদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটিতে দুজন নারী পাইলটের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

সেনাবাহিনীতে নারীদের আরো কৃতিত্ব : সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল ডা. নাজমা বেগম গত ফেব্রুয়ারিতে এ বাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পশ্চিম আফ্রিকার আইভরিকোস্টে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এক হাজার মিটার উচ্চতা থেকে মোট ছয়বার লাফ দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্যারাট্রুপার হিসেবে সনদ অর্জন করেন সেনাবাহিনীর তত্কালীন ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস। এরপর ওই বছরের ৮ এপ্রিল মেজর নুসরত নূর আল চৌধুরী (আর্টিলারি) বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী প্যারাট্রুপার হিসেবে সফলভাবে তাঁর পঞ্চম প্যারাশুট জাম্প সম্পন্ন করেন।

উল্লেখ্য, ২০০০ সালে বংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত কমিশনে নারী নিয়োগের যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিমানবাহিনীও একই উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ২০১৪ সালের আগে কোনো নারী বৈমানিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।