আফগানিস্তানের মানচিত্রের এক কোণের প্রায় ঝাপসা একটি গ্রাম ‘দাসবুজ’। ততোধিক ঝাপসা এই গ্রামের মেয়েরা। তালেবানের ভয়ে মুখ বুজে থাকতে হয় ওদের। পোশাক থেকে শিক্ষা—সব কিছুতেই তালেবানের আপত্তি। কিন্তু এসব মানতে রাজি নন রাজিয়া জান। তালেবানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই নারী প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাবুলি এডুকেশন সেন্টার’। ধর্মীয় গোঁড়ামির হামলা থেকে বাঁচাতে স্থানীয় মেয়েরা পালাক্রমে স্কুলটিকে পাহারা দেয়। ক্রমেই স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দাসবুজ গ্রামে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বোনে স্কুলটি। ‘হায়াট টুমরো ব্রিংস’ চলচ্চিত্রের সারসংক্ষেপ এটি। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের প্রত্যন্ত গ্রাম ‘সুন্দরবন’ যেন বাংলাদেশের ‘দাসবুজ’। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভে বড় বাধা ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়, অসচেতনতা। বাল্যবিয়ে নামক এক অভিশাপ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এই গ্রামসহ আশপাশের এলাকাকে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখতে না রাখতেই বেশির ভাগ মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। ‘ভালো’ পাত্র পেলে অনেক সময় প্রাথমিকের গণ্ডিও পেরুনোর সুযোগ মেলে না। তাই বাল্যবিয়ের জন্য সুন্দরবন গ্রামের দুর্নাম আছে। আশার কথা, বাল্যবিয়ে ও যৌন নির্যাতনের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে স্থানীয় মেয়েরা। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সারা বিশ্বের সাহস জাগানিয়া ডকুমেন্টারি দেখে সাহসী হয়ে উঠেছে সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা। এখন তারা নিজেরাই সব সমস্যার সমাধান করতে পারছে। তারা বাল্যবিয়ে বন্ধের পাশাপাশি যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ এমনকি ঝরেপড়া মেয়েদের স্কুলে ফিরিয়ে আনাসহ সব কিছুই করতে পারছে। সামাজিক প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সুন্দরবন স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির মেয়েরা মিলে গঠন করেছে ‘বেস্ট স্কুল গার্লস কমিটি’। কমিটিতে মোট ৩৫ জন সদস্য রয়েছে। গ্রামের কোনো মেয়ের বাল্যবিয়ের আয়োজন হলেই তারা একসঙ্গে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। বাল্যবিয়ের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে প্রথমে তারা সংশ্লিষ্ট অভিভাবককে বোঝানোর চেষ্টা করে। বুঝলে ভালো, না বুঝলে উপজেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয় তারা। এ ছাড়া কোনো মেয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলে তাকে যেকোনোভাবেই হোক ফিরিয়ে আনা হয়। ঝরে পড়া রোধে মেয়েদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যব্যস্থাও করে গার্লস কমিটি। যৌন নির্যাতন প্রতিরোধেও শতভাগ সফল সুন্দরবন স্কুলের মেয়েরা। ব্যতিক্রমী এক উপায়ে তারা এই সামাজিক ব্যাধি দূর করতে সক্ষম হয়েছে। বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে তারা একটি ‘অভিযোগ বাক্স’ রাখার ব্যবস্থা করেছে। কোনো মেয়ে কোনো বখাটের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে সে ওই বখাটে ও সহযোগীদের নাম লিখে অভিযোগ বাক্সে জমা দেয়। প্রতিদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর গার্লস কমিটির সভাপতি বাক্স খুলে দেখে। কোনো অভিযোগ জমা পড়লে কমিটির সদস্যরা সভায় বসে করণীয় ঠিক করে। এরপর সরাসরি ওইসব বখাটের বাড়িতে হাজির হয়ে প্রথমে তাদের অভিভাবকদের বিষয়টি জানানো হয়। অভিভাবকরা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনের সহযোগিতাসহ বিভিন্ন উপায়ে শাস্তির ব্যবস্থা করে গার্লস কমিটি। বেস্ট স্কুল গার্লস কমিটির সভাপতি ও সুন্দরবন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী শিল্পী মৃধা বলে, ‘গত দুই বছর ধরে কমিটি মাঠপর্যায়ে কাজ করে চলেছে। এলাকায় বাল্যবিয়ে ও যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি শতভাগ সফল হয়েছে।’ শিল্পী আরো বলে, ‘আগে আমরা এতটা সাহসী ছিলাম না। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন সার্ভিসের (আইটিভিএস) উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহে ডকু-ফিল্ম দেখে আমরা সাহসী হয়েছি। সংস্থাটি কমিটির কাজে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। তাদের সহযোগিতা না পেলে আমাদের পক্ষে এমন কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হতো।’ সামাজিক নানা বাধা পেরিয়ে ক্রীড়া ক্ষেত্রেও নজির সৃষ্টি করছে সুন্দরবন স্কুলের মেয়েরা। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, দৌড়, উচ্চ বা দীর্ঘ লাফেও সমান পারদর্শী ওরা। বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আসমা খাতুন খুলনা বিভাগে ২০০ মিটার দৌড় এবং উচ্চ লাফে বরাবরই প্রথম হয়ে আসছে। ক্রিকেট-ফুটবলেও শ্যামনগর উপজেলায় সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন। ওরা এখানেই থেমে থাকেনি। স্কুলের মেয়েরা প্রতি সপ্তাতে ‘বেলাভূমি’ নামে একটি পত্রিকা বের করে। ‘বিজ্ঞান ক্লাব দেয়ালিকা’ নামে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পত্রিকাও রয়েছে। প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত কুমার বৈদ্যর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবন স্কুলের মেয়েরা সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ, খেলাধুলা ও পড়ালেখায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কোলের প্রত্যন্ত এই লোকালয়ে নানা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন সার্ভিস (আইটিভিএস) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটির কান্ট্রি এনগেজমেন্ট কো-অর্ডিনেটর সৈয়দ মাহমুদ হাসান হলেন নেপথ্যের মূল ব্যক্তি। শুধু সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নয়; সাতক্ষীরা ৮৭টি, নওগাঁর পত্নীতলা ও মহাদেবপুরের ৮৭টি, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ৫৬টি, রংপুরের গঙ্গাচড়ার ৫৩টি এবং মেহেরপুরের ৭০টি বিদ্যালয়ে আইটিভিএসের এমন কার্যক্রম চালু রয়েছে। জানতে চাইলে মাহমুদ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মেয়েরাই যে শুধু সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে, তা নয়। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের চিত্র এর চেয়ে ভয়াবহ। আইটিভিএস ওইসব দেশের নারীদের বাস্তবভিত্তিক কাজের সাফল্যের চিত্র ডকুমেন্ট ফিল্মের মাধ্যমে তুলে ধরে তাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের কাছে আমরা এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে চাই যে, অন্য দেশের মেয়েরা পারলে তোমরা পারবে না কেন?’ f