স্বপ্ন দেখে ওরা এখন – আশরাফুল ইসলাম

গল্পটা যেন নাটক সিনেমাকেও হার মানায়। খুব বেশিদিন আগের নয়, ২০০৬ সালের গোড়ার দিকের কথা। অন্যের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করে সংসার চলতো আনোয়ারার। স্বামী অসুস্থ, আয়-রোজগার করার কেউ নেই। নিজের জায়গা-জমি বলতেও কিছু নেই। তাইতো অপেক্ষাকৃত ধনী মানুষের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ, কখনো বা অন্যের খেতে আলু বা তামাক পাতা তোলার কাজ করে যা জুটতো তা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে সংসার চলতো তাদের। আর কাজ না থাকলে উপোস থাকা। এভাবে কতদিন যে ছোট-ছোট ছেলে-মেয়ে মিলে পুরোবেলা বা আধাবেলা না খেয়ে থেকেছেন তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু আজ ১০ বছরের ব্যবধানে দিন পাল্টেছে। নিজের ভিটায় এখন উঠেছে সুন্দর দালানঘর। হাতে মোবাইল ফোন, পরনে সুন্দর পোশাক। জমিতে ফসল, বাড়িঘর গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগিতে ভরা। বেড়েছে সামাজিক মর্যাদাও। শিখেছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ রোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি ও দুর্যোগ মোকাবিলার মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এভাবে শুধু আনোয়ারা নন, রংপুর সদর উপজেলার ঈশ্বরপুর গ্রামের আসমা, আলেয়া, ফাতেমাসহ অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। দু’চোখ ভরে এখন ওদের অনেক স্বপ্ন। নিজেরা স্বপ্ন দেখে বড় হওয়ার, আবার অন্যকে বড় হওয়ার উত্সাহ যোগাচ্ছে তারা। যেন উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে একদা হতদরিদ্র এসব মানুষ। অথচ মাত্র ১০ বছর আগেও এরা কেউ ভিক্ষা করতো, নয়তো অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো কিম্বা অন্যের জমিতে মজুরি খাটতো। এমনকি চুরির মত জঘন্য কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিল অনেকে। ছিল না সামাজিক  কোনো সম্মান। কিন্তু বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ব্র্যাকের অতিদ্ররিদ্র কর্মসূচি এদের জীবন একেবারে বদলে দিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় এসে তারা আজ তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছে।

 

জানা যায়, ২০০৬ সালে অতিদরিদ্রপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত রংপুরের তারাগঞ্জ ও সদর উপজেলার এই গ্রামগুলোকে প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের জন্য বেছে নেয় বৃহত্ এনজিও ব্র্যাক। গ্রামের সকল শ্রেণির উপস্থিতিতে এক বিশেষ পদ্ধতিতে বাছাই করা হয় এসব হতদরিদ্র পরিবারকে। যেখানে সম্পদের স্তরবিন্যাসের ভিত্তিতে ৬টি শ্রেণিভুক্ত করে নিচের দু’টি শ্রেণিকে প্রকল্পের প্রাথমিক বাছাইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারের সকল সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতামুক্ত, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ভূমিহীন, অসচ্ছল, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এমনকি রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে এই বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপর আবারো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ক্রসচেকিংয়ের মাধ্যমে এদেরকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়।

 

এরপর স্থানীয় মাঠকর্মীদের নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে দু’বছর ধরে চলতে থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। বাছাইকৃতদের জন্য আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী আয়বর্ধক সম্পদ হিসেবে এদের মাঝে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গরু বিতরণ করা হয়। সঙ্গে গবাদিপশুর ঘর বানানোর জন্য দেয়া হয় ঢেউটিন। প্রদেয় গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি রোগাক্রান্ত হলে থাকে বিনামূল্যে চিকিত্সা সহায়তা। পাশাপাশি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন নিয়ে গঠিত গ্রাম দারিদ্র্য বিমোচন কমিটিও নানাভাবে এদেরকে সহায়তা করে থাকে। আর মধ্যবর্তীকালীন এসময়ে এসব গরু-ছাগল যাতে বিক্রি করে না খেতে হয়, সেজন্য খাবারে বিশেষ ভর্তুকি দেয়া হয়। নিয়মিত আয়-রোজগারের পাশাপাশি খাদ্যে ভর্তুকি হিসেবে প্রতি সপ্তাহে দেয়া হয় নগদ ১৬০ টাকা ও ৫০ টাকা মূল্যমানের মুসুরির ডাল। ফলে নিজের কাজের জন্য বাড়তি যে সময় ব্যয় হয় তা এই ভর্তুকির মাধ্যমে পুষিয়ে দেয়া হয়।

 

অন্যদিকে সংস্থার মাঠকর্মীদের মাধ্যমে এদেরকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতামূলক নানা বিষয়ে হাতে-কলমে জ্ঞান দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সুপেয় খাবার পানি, বাল্যবিবাহ রোধ, যৌতুকের কুফল, ভূমিকম্প, বন্যা, ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া। বাড়ির আশেপাশের খালি জায়গায় শাক-সব্জি ফলমুলের বাগান তৈরিতেও উত্সাহিত করা হয়। পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি বা চুরির মত জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ দেয়া হয়। এমনকি সদস্যদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিপদ-আপদেও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মাঠকর্মীরা। এভাবে নিবিড় পরিচর্যায় থাকার ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায় সকলেই স্বাবলম্বী হয়ে যান। এরপর আরো সহযোগিতার হাত বাড়াতে সহজশর্তের ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। ফলে একদা ভিক্ষুক কিম্বা ঝি-এর কাজ করা মহিলাটিই এখন স্বপ্ন দেখছে বড় হওয়ার। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাড়িতে উঠেছে দালান। ছেলে-মেয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজে। বেড়েছে সামাজিক মান-মর্যাদাও। আর এভাবেই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে আজ ওরা বেরিয়ে এসে নিচ্ছে সত্যিকারের মুক্তির নিঃশ্বাস।

 

পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই প্রশংসনীয় সাফল্য সত্ত্বেও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের আরও অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।