আশার কথা, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথে হাঁটছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশাবাদ রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তবে এ কৃতিত্ব শেখ হাসিনা বা তার সরকারের একার নয়, দেশের সর্বশ্রেণির বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের চেষ্টা, সংগ্রাম ও সাফল্যই দেশের বর্তমান সাফল্য। দেশে সর্বশ্রেণির মানুষ পরিশ্রম করেই দেশকে অর্থনৈতিক এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। উন্নতির ধরন দেখে চমকে গেছে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নও। বাংলাদেশকে সমীহ করতে শুরু করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাই মনে করছে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ ২৩তম উন্নত অর্থনীতির দেশ হবে। বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বের দরবারে একটি অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশে পরিণত হবে। এজন্য জাতীয় ঐকমত্য যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও। এ দায়িত্ব দেশের সব রাজনৈতিক দলের, দেশের ১৬ কোটি মানুষের। বর্তমান সরকারের দায় আরো বেশি। আমরা আশাবাদী। জয় আমাদের হবেই।
সালাম সালেহ উদদীন
দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটেছে। এ বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তির উদ্যোগ, প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, শ্রম একদিকে যেমন কাজ করেছে, অন্যদিকে সরকার তথা রাষ্ট্রের ভূমিকাও কম নয়। তাই বাংলাদেশকে অনেক রাষ্ট্রই এখন এশিয়ার বাঘ বলছে। এ দেশ যে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে_ এটা বাংলাদেশের জন্য বড় পাওনা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। তখন আমাদের ললাটে হতদরিদ্র রাষ্ট্রের অভিধা ছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে এসে আমরা অন্য এক বাংলাদেশকে দেখতে পাচ্ছি। এবার জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.০৩ এবং মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৬৬ ডলারে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। রাষ্ট্র, সরকার ও দেশের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিরাজ করছে দেশে।
গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ লাভ করেছে অভাবিতভাবে। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রবাসে কর্মরত। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের আয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ১৩১ কোটি ২৬ লাখ ইউএস ডলার। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকেই শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৭৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আর এর ইতিবাচক প্রভাব শুধু জনজীবনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তাদের রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণপ্রবাহের সৃষ্টি করেছে। বদলে গেছে গ্রামীণ অবকাঠামোও।
২০-২৫ বছর আগে যেসব লোক গ্রামে শ্রমিকের কাজ করত, বাড়িতে ছিল শণের বা মাটির ঘর, কাঁচা পায়খানা, এক বেলা খেতে পেত তো অন্য বেলা পেত না, তাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন নিজ ভিটায় অথবা অন্যত্র জায়গা কিনে দৃষ্টিনন্দন দালান তৈরি করেছে। কারো কারো বাড়ির আঙিনায় শোভা পাচ্ছে রকমারি বৃক্ষ ও ফুলের গাছ, দামি গাড়ি। এসব পরিচর্যা করার জন্য চাকর-বাকরও রেখেছে কেউ কেউ। এদের ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা অলস পড়ে আছে। এদের কেউ কেউ অবশ্য উৎপাদনশীল খাতে যেমন_ ব্রয়লার, পোল্ট্রি ও মৎস্য খামারেও বিনিয়োগ করছে। গ্রামীণ দুস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য বিদেশ থেকে এসে কেউ কেউ নানা প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। কেউ কেউ শহর, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকারখানা, ক্লিনিক, ডায়াগনিস্টক সেন্টার করার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেয়েছে নতুন মাত্রা। অন্যদিকে গ্রাম পর্যায়ে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ঘটার ফলে গ্রাম আর সাধারণ গ্রাম নেই। গ্রামীণ টাউট, বাটপাড় ও তৃণমূল পর্যায়ে পাতি নেতাদের, দৌরাত্ম্য সর্বত্র। চাঁদাবাজি, দুর্নীতির মাধ্যমে এরা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে। গ্রাম পর্যায়ে এদের দাপট সীমাহীন। এদের একটি অংশ এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেছে। মনোনয়ন পাওয়াসহ নির্বাচনে খরচ করেছে প্রায় কোটি টাকা। কালো টাকায় দাপট আর কাকে বলে?
সত্তর দশকে যারা জনপ্রতিনিধি হতেন, তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল না। অন্যের টাকায় তারা নির্বাচন করতেন। চেয়ারম্যান প্রার্থীর বাড়িতে টিনের ঘর আর মেম্বার প্রার্থীর বাড়িতে শণের ঘর ছিল। লাল চা, মুড়ি, টোস্ট বিস্কুট আর বিড়ির সাহায্যে তারা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতেন। আর এখন মেম্বার প্রার্থীর বাড়িতে আলিশান দালান, চেয়ারম্যানের কথা তো বলাই বাহুল্য। নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খচর করা এখন কোনো ঘটনাই নয়। অর্থাৎ সর্বত্র টাকার ছাড়ছড়ি। এই বিপুল অর্থ যে সৎপথে উপার্জিত নয়, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সৎপথে হোক আর অসৎ পথে হোক গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হওয়ার এটাও একটা উল্লেখযোগ্য দিক। গ্রামে এখন আর পর্ণকুটির, হাড় জিরজিরে জীর্ণশীর্ণ মানুষ চোখে পড়ে না। গ্রামের রাস্তাঘাটও আগের চেয়ে উন্নত। যে পরিবারের ছেলেমেয়েরা একসময় শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত না, তারা এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বুয়েট, মেডিকেলেও পড়ছে। গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, এটাও অর্থনৈতিক কারণেই।
এনজিওর সহযোগিতায়ই হোক, হোক নিজের প্রচেষ্টায় গ্রামের মহিলারা, সাধারণ মানুষ আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করেছে। কেউ বাড়ির মজাপুকুরে মাছ চাষ করছে, কেউ বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি ফলাচ্ছে, কেউ সেলাই শিখে দোকান দিয়েছে, হয়েছে প্রশিক্ষক, কেউ স্থানীয় বাজারে, পাড়ায় দোকান দিয়ে স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে। এ ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে অনেকেই। যার একখ- জমি ছিল না সে জমি কিনেছে, যার ঘর ছিল না সে ঘর দিয়েছে। অর্থাৎ এভাবেই ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তনের আরো একটি দিক হচ্ছে জাতিসংঘের অধীন শান্তি মিশনে যাওয়ার সুযোগ। কোনো কোনো পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা একাধিকবার মিশনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা পেয়ে ব্যক্তি ও পরিবারের জীবনে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। অনেকেই জমি, ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে, নিজস্ব ব্যবসাও গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশের নাগরিকরা যদি শান্তি মিশনে যাওয়ার সুযোগ না পেত, তাহলে তাদের পক্ষে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব ছিল না।
আমরা যদি নিম্নবিত্তের দিকে তাকাই সেখানে দেখব, ব্যাপক আকারে অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে একজন রিকশাচালক দিনে দুইশ থেকে তিনশ টাকা উপার্জন করত; এখন জীবনযাত্রার মান রক্ষা করতে ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজের উপার্জন নিজেই বাড়িয়ে নিয়েছে। রিকশায় উঠলেই ২০ টাকা দিতে হয়। ফলে দিনে তার উপার্জন ৮০০ থেকে হাজার টাকা। একইভাবে চা বিক্রেতা, শাক-সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, নিত্যপণ্যের যে কোনো ক্ষুদ্র, মাঝারি ব্যবসায়ী ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। তাদের উপার্জন এখন একজন বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তার চেয়ে বেশি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়টি এখানে উদাহরণ হতে পারে না, কারণ তাদের বেতন-ভাতা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, এমনকি পেনশন আকাশছেঁাঁয়া। একজন পুরি বিক্রেতাও মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা উপার্জন করে। সুতরাং তৃণমূল পর্যায়ের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ উজ্জ্বল। মানুষের জীবনযাপনই বদলে গেছে। একজন গৃহপরিচারিকা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করে। তাদের দাপটই অন্যরকম। নির্মাণশ্রমিক, রিকশাচালক, গৃহপরিচারিকা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা সবারই উপার্জন ভালো এবং তাদের প্রত্যেকের হাতেই মোবাইল সেট। কারো কারো হাতে স্মার্টফোনও চোখে পড়ে। যারা তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে তাদের অবস্থাও এখন ভালো। একসময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী শ্রেণিকে নিম্ন আয়ের লোকেরা ঈর্ষা করত, ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণাও করত, কেবল অর্থনৈতিক কারণে।
কিন্তু গত পাঁচ বছরে উভয় শ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা চলে এসেছে। বেসরকারি পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার সমান অথবা বেশি উপার্জন করে তারা। এদের অনেকেই এখন মাঝারি মানের ফ্ল্যাটে থাকে, যার ভাড়া ১২ থেকে ১৬ হাজার। এই যে পরিবর্তন এই পরিবর্তনের প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়েছে। তাই তো সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এখন দেশে একজন মানুষও না খেয়ে মরছে না। উত্তরবঙ্গের কার্তিকের মঙ্গাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দারিদ্র্যের হার কমছে, বাড়ছে শিক্ষার হারও। কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধনী-দরিদ্রের আকাশ-জমিন ব্যবধান কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ২৭.০৪ বিলিয়ন ডলার। সংগত কারণেই বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের এ উন্নতিতে বিস্মিত, বিমোহিত। অর্থনীতি ম্যাজিক নয়, জাদুদ-ে ভোল পাল্টানো যায় না। অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়। ব্যাপক এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। তার টানা সাত বছরের শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রণীত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ প্রতিবেদনে আশা করা হয়েছে, বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এ ছাড়া পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হাত ধরেও সার্বিক রপ্তানি বাড়বে বলেও আশা করা হয়েছে।
আশার কথা, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পথে হাঁটছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশাবাদ রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তবে এ কৃতিত্ব শেখ হাসিনা বা তার সরকারের একার নয়, দেশের সর্বশ্রেণির বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের চেষ্টা, সংগ্রাম ও সাফল্যই দেশের বর্তমান সাফল্য। দেশে সর্বশ্রেণির মানুষ পরিশ্রম করেই দেশকে অর্থনৈতিক এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। উন্নতির ধরন দেখে চমকে গেছে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নও। বাংলাদেশকে সমীহ করতে শুরু করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাই মনে করছে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ ২৩তম উন্নত অর্থনীতির দেশ হবে। বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বের দরবারে একটি অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশে পরিণত হবে। এজন্য জাতীয় ঐকমত্য যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও। এ দায়িত্ব দেশের সব রাজনৈতিক দলের, দেশের ১৬ কোটি মানুষের। বর্তমান সরকারের দায় আরো বেশি। আমরা আশাবাদী। জয় আমাদের হবেই।