স্বাধীনতার পর থেকেই ধাপে ধাপে উন্নতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতির। প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটি সূচকেই যোগ হয়েছে নতুন পালক। স্বাধীনতার পর যখন নুন আনতে পান্তা ফুরাত, সেদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক সময় ৯২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। আজ ৬৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য জয় করেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন ২৪ শতাংশের কিছু বেশি। আবার দেশে নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে উচ্চবিত্তের সংখ্যাও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির সাফল্যের এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে এর স্বীকৃতিও মিলেছে। তবে এটাও ঠিক, আমাদের সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করা যায়নি। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে আমাদের প্রায় সব অর্জন এসেছে খেটে খাওয়া মানুষের হাত ধরে। আয় বণ্টনে বৈষম্য নীতির কারণে দরিদ্র মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল খুব একটা পায়নি। আগামীতে সুষম উন্নয়নে জোর দিতে হবে। তাছাড়া শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
চলতি অর্থবছরেই বৃত্ত ভাঙার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু চোখ রাঙাচ্ছিল এক যুগেরও বেশি সময়ের পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যান বলে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে তো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনই সম্ভব হচ্ছে না। ‘লাকি সেভেনের’ ব্যাপারে হতাশার বাণী শোনাচ্ছিল বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। তবে সব চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এবার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবে, এবার প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। প্রথম বারের মতো প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘর অতিক্রম করার বিষয়টিকে অর্থনীতির বড় অর্জন হিসেবে মূল্যায়ন করছেন অর্থনীতিবিদরা।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৯২ শতাংশ মানুষ। সময়ের ব্যবধানে এ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশে। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়ন প্রতিবেদন মতে, গত ৫ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯১-৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে জাতিসংঘের প্রশংসা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, মধ্যবিত্তের আকার বড় হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হয়। মধ্যবিত্ত যত শক্তিশালী, অর্থনীতি তত ভালো হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। অব্যাহতভাবে এ হার বেড়ে চলেছে। ২০৩৩ সালের মধ্যে মোট জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। অথচ ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ ছিল মধ্যবিত্ত। শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণীই বাড়েনি, বেড়েছে তাদের সামর্থ্যও। এসডি এশিয়ার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৩৬টি শহরে বর্তমানে ১ লাখের বেশি মধ্যবিত্ত পরিবার আছে। ২০২৫ সালে এমন শহরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬১।
বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন এখন চাহিদার প্রায় সমান। বড় ধরনের দুর্যোগ না হলে এ খাতে অন্য দেশের সহায়তা নেয়ার প্রয়োজন নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, ৪৪ বছরে দেশের ধান চাষের জমি ১৮ শতাংশ কমেছে। তবে এ সময়ে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ গুণ। ফলে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও কমে এসেছে খাদ্যঘাটতি। অন্য ফসলেও উৎপাদন বৃদ্ধি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। ৪৪ বছরে দেশে আলুর ফলন প্রায় ১১ গুণ বেড়েছে। একই সময় গমের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। দ্বিগুণ জমি চাষের আওতায় এলেও ৪৪ বছরে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৭৫৭ গুণ। কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে দেশ। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে বাড়ছে শিল্প খাতে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সেবা খাত। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল প্রায় ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। যার কারণে অর্থনীতিতে তিনটি বৃহৎ খাতের মধ্যে কৃষির অবদান এখন তৃতীয়।
বৈশ্বিক মন্দা অর্থনীতির মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, এক দশকের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির পরিধি প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করছে ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫ প্রতিষ্ঠান। ২০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৪৪। ১৯৮৬ সালে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৯২৬। বর্তমানে তা ৪৫ লাখ ১৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে।