অবরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় বেশ কয়েক মাস ধরেই শ্লথ গতিতে ঘুরছিল অর্থনীতির চাকা। বিশেষ করে দেশীয় পণ্যের বাজারে প্রকট হয়ে ওঠে বাণিজ্যিক মন্দা। নানামুখী সংকটে পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে দেখা দেয় এক ধরনের স্থবিরতা। তবে বৈশাখী কেনাকাটা এবার জমে ওঠায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে সর্বস্তরের ব্যবসা; চাঙা হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি।
ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘বৈশাখী ভাতা’ পেয়ে তা দু’হাতে খরচ করায় জাতীয় অর্থনীতিতে গতি এসেছে। তাদের ভাষ্য, বেশ কয়েক বছর ধরেই বৈশাখী কেনাকাটা বাড়লেও এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। নামিদামি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই বেচাকেনা তাদের টার্গেট ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ব্র্যান্ড শপগুলো ক্রেতার চাহিদা সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সব মিলিয়ে বৈশাখের অর্থনীতির কর্মকা-ের পরিমাণ এবার আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি করেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা জানান, একটা সময় পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার এই আয়োজন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। আর এর ওপর ভিত্তি করেই গ্রামীণ নানা অর্থনৈতিক কর্মকা-েরও বিকাশ হয়। কিন্তু ব্যস্ত নগরজীবনেও এখন নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামমুখী ওই উৎসব এখন হয়ে উঠেছে শহরমুখী। আর শহরের মানুষ এই উৎসবটি উদযাপন করছে নানাভাবে। আর সে কারণে কিছু অর্থনৈতিক কর্মকা- হচ্ছে নগরেও। এসবের ফলে দেশে পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক ছোটখাটো একটা অর্থনীতিও গড়ে উঠেছে। প্রতিবছরই বাড়ছে এসব অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিধি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। মুঠোফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট পর্যন্ত অনেক কিছুতেই দেয়া হচ্ছে লোভনীয় ‘বৈশাখী অফার’।
বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বৈশাখ উপলক্ষে এবার শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকই বিক্রি হবে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে চুড়ি, মালা, দুল, মাটির তৈরি পণ্য, কুটিরশিল্পসহ নানা পণ্য বিক্রির টার্গেটও ছাড়িয়ে যাবে। এসব কাজে যত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে তা হিসাব করা হলে এই অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিমাণ সাত-আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
একাধিক ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তারা জানান, সারাবছর তাদের যে ব্যবসা হয় তার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে। পহেলা বৈশাখে হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর বাকিটা সারাবছর। তবে এবার বৈশাখী পণ্যের যে বেচাকেনা হয়েছে তাতে এখনই ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শেষ সময় এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে তা ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে।
দেশে এখন যে সাড়ে চার হাজারের মতো ফ্যাশন হাউস আছে এদের মধ্যে মূল ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ উদ্যোক্তার দাবি, অবরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশকিছুদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল। যার প্রভাবে বেশকিছু ছোটখাটো ফ্যাশন হাউস এরই মধ্যে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে লোকসানের মুখেও যেসব ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবারের বৈশাখের বিক্রিতে তাদের ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে।
তাদের দাবি, গত বছরের চেয়ে এবারের বৈশাখী পণ্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বিক্রি হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতা পাওয়ায় এ গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
ফ্যাশন এন্টারপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন
অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কাটিয়ে দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি আবার সুদিনের প্রত্যাশায় নতুনভাবে পথ চলতে শুরু করেছে। বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক হানাহানির দরুন বেশকিছু মাঝারি ও ছোট পরিসরের ফ্যাশন হাউস ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু ফ্যাশন হাউসের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনো দোদুল্যমান। এমনকি অনেক বড় ফ্যাশন হাউসগুলো তাদের আউটলেটের সংখ্যা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন। ফলে যে শুধু দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়। দেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও রয়েছে হুমকির মুখে। ব্যবসায়ী এই নেতার দাবি, এবার বৈশাখে এক হাজার পাঁচশ থেকে এক হাজার সাতশ কোটি টাকার পোশাক বিক্রির আশা রয়েছে। যেভাবে ভাবা হয়েছে এখনো পর্যন্ত সেভাবেই চলছে। সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা পজেটিভ আছে।
বৈশাখী পণ্য বিশেষ করে পোশাক বেচাকেনায় যে ব্যাপক জোয়ার লেগেছে তা রাজধানীর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢু মারলেই অনায়াসেই টের পাওয়া গেছে। রোববার আড়ংয়ের মগবাজার ও গুলশানসহ বেশ কয়েকটি আউটলেট ঘুরে দেখা গেছে, সাধারণ সাইজের জামা, ফতুয়া, পাঞ্জাবি বিক্রি হয়ে গেছে। বিশেষ করে মেয়েদের পোশাকে বড় ধরনের ঘাটতি চোখে পড়েছে।
রোববার আড়ংয়ের মগবাজার আউটলেটে বৈশাখী সেলোয়ার-কামিজ কিনতে আসা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নূসরাত জাহান জানান, মাত্র তিনদিন আগে দুই বান্ধবী মিলে পছন্দমতো পোশাক কিনে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ তাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।
একই সুরে হতাশা প্রকাশ করেন মগবাজারের ডাক্তার গলির বাসিন্দা ইমাম হাসান। তিনি জানান, দুদিন আগে ছেলের জন্য পছন্দমতো পাঞ্জাবি ও ফতুয়া কিনে নিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন তার সাইজের পছন্দমতো কোনো পাঞ্জাবিই পাচ্ছেন না।
এদিকে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে দই-মিষ্টিসহ বেকারিজাত পণ্যের বেচাকেনারও ধুম পড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এক সময় বৈশাখের প্রথম দিনটিতে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলে নতুন বছরটিকে স্বাগত জানাতেন। কালের আবর্তে সে রেওয়াজ প্রায় হারিয়ে গেলেও মিষ্টি দিয়ে দিনটি বরণ করতে ভোলেননি তারা। এ ছাড়া বৈশাখের দিন বিভিন্ন করপোরেট হাউসগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের অফিসে মিষ্টি পাঠানোর নতুন রেওয়াজ চালু করেছে। পাশাপাশি শহুরে মানুষ এদিন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও মিষ্টিজাত পণ্য বিতরণ করছে।
সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, স্বাভাবিক সময়ে একটা দোকানে প্রতিদিন যত মিষ্টি বিক্রি হয়, এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন তার তিনগুণ বিক্রি হয়। আর পহেলা বৈশাখের বিক্রি দ্বিগুণ।
এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারো শুভেচ্ছাকার্ড ও বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার উপহার দিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাও জমে উঠেছে। এর সঙ্গে মাথায় পরার কাগজের টুপি এবং বিভিন্ন বৈশাখী বইমেলার জন্য বই ছাপিয়ে বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থনীতি চাঙ্গ করেছে। সব মিলিয়ে মুদ্রণশিল্পে আনুমানিক দশ থেকে ১২ কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।