বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশই হচ্ছে বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থ অর্থাৎ প্রবাসী আয়। বিদেশে কর্মসংস্থানের মধ্যদিয়ে একেকটি পরিবারে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমনি তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে জনসংখ্যা রপ্তানির ওপর সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক উদ্যোগও রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে অর্জিত এই রেমিট্যান্সের বড় একটি অঙ্কই জমি ক্রয়ে অর্থাৎ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে গতকাল যায়যায়দিনে খবর এসেছে। এরপরই এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে পারিবারিক খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে। আবার বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাতে ব্যাংকব্যবস্থা সক্রিয় থাকলেও হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ পথে আসছে রেমিট্যান্সের একটি অংশ। যাতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে উঠে আসা এ তথ্য উদ্বেগের বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাসী আয় গ্রহণকারী পরিবারগুলো এক বছরে যে পরিমাণ অর্থ গৃহে নির্মাণের টেকসই জিনিসপত্র ক্রয়ে ব্যয় করে তার মধ্যে ৭৮ শতাংশ অর্থ জমি ক্রয়ে ব্যবহৃত হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে এ হার আরো বেশি। বরিশাল, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে জমি ক্রয়ে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ টাকা ব্যয় করা হয়। তবে চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বনিম্ন ৫৬ দশমিক শূন্য ৫ এবং এরপরই সিলেট বিভাগে ৬২ দশমিক ৭০ শতাংশ টাকা জমি ক্রয়ে ব্যয় হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেমিট্যান্সের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হলে তা দেশকে আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে প্রবাসী এই আয় বিনিয়োগ খাতে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা আরো স্বস্তিকর অবস্থানে যেতে পারে, মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে প্রবাসীদের অর্থ উৎপাদনশীল বিনিয়োগ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরাও বিশ্বাস করি।
আশার কথা যে, বর্তমান সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ প্রকৃত খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটি অবশ্যই সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। পাশাপাশি জানা যাচ্ছে, প্রবাসী আয় ব্যবহারের ওপর এ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য নীতিনির্ধারণী কাঠামো প্রণীত হয়নি। আমরা মনে করি, প্রবাসী আয়কে গতিশীল এবং উৎপাদনমুখী খাতে ব্যবহারের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো প্রণয়নসহ বিনিয়োগের নিরাপত্তার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আবার অনেকে এটাও মনে করেন যে, প্রবাসী আয় দিয়ে যদি জমি কেনা হলে তা বিনিয়োগের পর্যায়েই পড়ে। এতে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বাড়লে তা জিডিপিতে অবদান হিসেবে যোগ হয়। তবে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার যে অংশটি প্রবাসীরা বিদেশেই সঞ্চয় করেন, সেই অংশটি যাতে তারা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, সে বিষয়ে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। আমরা মনে করি, পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে এ ব্যাপারেও সরকারের যথাযথ দৃষ্টি দেয়া জরুরি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ জনবহুল একটি দেশ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার নতুন নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান করা। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য প্রণোদনার মাধ্যমে সঞ্চয় করা প্রবাসী অর্থ দেশের উৎপাদনে বিনিয়োগের যথাযথ ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। এজন্য উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপনে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগসহ নানাবিধ প্রক্রিয়া আরো সহজতর করার যথাযথ উদ্যোগ নেয়া। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো আয় দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। আমরা মনে করি এ খবর তখনই ইতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হতে পারে যখন এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যথাযথ খাতে বিনিয়োগ করা যাবে। যার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হবে দেশ ও জাতি। আর এর নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকেই। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশ আরো এগিয়ে যাক, সমৃদ্ধির সোপানে যুক্ত হোক, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
রেমিট্যান্সের প্রবাহ
উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিন