সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ

সম্প্রতি আমার বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পিতৃপুরুষের ভিটে দেখার বাসনা থাকে সকলের। তাছাড়া বাবার জন্মস্থান। অনেক গল্প শুনেছি। রাজধানী ঢাকার সনি্নকটে সাভার থানার একটি গ্রাম। বাবা তার শৈশব এবং কৈশোরের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এই গ্রামে। ১৯৭১ সব ওলট পালট করে দিয়েছে। বাবার কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা। এক কাপড়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন অনেকের সাথে। জেনেছিলেন গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল অবস্থানরত অনেককে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাবার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। কর্মসংস্থানের ব্যস্ততায় দক্ষিণ কলকাতায় শুরু করেছিলেন নতুন জীবন।
আমার মায়ের পূর্ব পুরুষেরা বাংলাদেশে পূর্বের বরিশাল জেলা এবং বর্তমানের ভোলা জেলার অধিবাসী ছিলেন। দাদু পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। চাকরির সুবাদে কলকাতায় অবস্থান থাকায় ৪৭ এর দেশ বিভাগের পর সেই কলকাতাতেই থেকে গিয়েছিলেন। দাদুর কাছে মেসোর কাছে সেই সুদূরের অনেক গল্প শুনেছি। বিশাল বিশাল নদী পার হয়ে স্টিমারে করে যাতায়াত। ঝড়ের দিনের অভিজ্ঞতাও ছিল ভিন্ন। দাদুর পরিবারে এখনও আভিজাত্যের ছাপ আছে। শত বছরের অধিক পুরাতন বাক্স, গহনা, থালা-বাসন বা কারুকার্যম-িত জিনিসপত্র অতি যত্নে রক্ষিত। সম্প্রতি দাদু গত হয়েছেন। বাংলাদেশ তার দেখা হয়ে ওঠেনি। আমার এক মেসো প্রায় একযুগ বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। গত বছর তিনি কলকাতায় ফিরেছেন। আমার স্বামীর পিতার বাড়িও ছিল টাঙ্গাইল শহরে। এখনও নাকি বাড়িটি আছে। অন্য আত্মীয়রা থাকেন। ৪৭ এর পর আমার শ্বশুর মশাই আসামে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই আমার স্বামীর জন্ম।
বলতে হয় বাংলাদেশের সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক। বাবা বলতেন কাসা শিল্পের জন্য উপমহাদেশে তাদের গ্রামটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। আজো নাকি এর বিকল্প গড়ে ওঠেনি। নদী, বিল, ধানক্ষেত, কুমোর বাড়ির কত গল্প। বাবা আজো তার ছোট বেলার সকল স্মৃতি মনে রেখেছেন। বাবার ঘনিষ্ট অনেক আত্মীয় বন্ধু এখনও ঐ গ্রামে বাস করেন। অনেকবার আসতে চেয়েছেন বাংলাদেশে। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় হয়ে ওঠেনি। আমার বহু দিনের ইচ্ছে ছিল বাবার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ দেখার। সুযোগ হলে বাবাকেও একবার তার গ্রাম দেখাতে চেষ্টা করব।
এর মধ্যে সুযোগ এল বাংলাদেশের একটি সংবাদ সংস্থায় কাজ করার। সংস্থার কলকাতা অফিসের দায়িত্ব এলো আমার ওপর। বাংলাদেশকে জানার আগ্রহ আরো প্রবল হলো। ভাবনাও ছিল বাংলাদেশ দেখার। কয়েকবার সুযোগ এসেছিল কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যাওয়ার এক সুযোগ এলো। আমাদের সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক এ এস এম সামছুল আরেফিন বাংলাদেশের একজন উল্লেখযোগ্য গবেষক। তার গবেষণা গ্রন্থসমূহ বাংলাদেশে এবং বিদেশে আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত। সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তার সাথে আমার গবেষণায় থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যৌথ গবেষণায় ভারতের ওপর প্রকাশিত হয়েছে আমাদের ৪টি গবেষণা গ্রন্থ। ২০১৬ সালে পূর্ণ হলো এ এস এম সামছুল আরেফিনের গবেষণার ৪০ বছর। ১৬ জানুয়ারি তার জন্মদিন হওয়ায় তার গবেষণার ৪০ বছর উদযাপনের জন্য এই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল। এবার আমি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। আমন্ত্রিত হয়ে স্বামীর সাথে ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় পেঁৗছলাম।
ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে মনে হলো না আমরা কলকাতার বাইরে এসেছি। একই ধরনের পোশাক, একই ভাষায় কথা বলা, আলাপ ব্যবহারের ধরন একই। বিমান বন্দর থেকে যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম রাস্তার দুধারের গাছপালা। সবই একই রকম। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়। কেন দুটি দেশ হলো। আমার চিন্তায় এখন বাংলাদেশ দেখার সাধ। কি কি দেখব তার একটি বিশাল তালিকা ছিল। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, দাদুর বাড়ি, মন্দির, মসজিদ, শহীদ মিনার আরো কত কিছু। কিন্তু সময় কতটুকু হিসেবের সময় তা বিবেচনায় ছিল না।
হোটেলের আতিথিয়তায় কোন কার্পণ্য নেই। যেন তাদের কত পরিচিত আমরা। এলাকাটি গুলশান। ঢাকার অতি অভিজাত এলাকা। মেসোর অফিস ছিল এখানে। মাসিমাও অনেকদিন ঢাকার এই এলাকায় কাটিয়েছেন। ছেলের পড়াশুনার কারণে তাকে একসময় কলকাতায় ফিরে যেতে হয়েছিল। মাসিমার কাছে এই গুলশান বনানীর অনেক গল্প শুনেছি। মেসো মাসিমার পরিচিতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম পরিবার। বর্ণনায় একের সাথে অন্যের সম্পর্ক কত গভীর ছিল তার বিবরণ ছিল বেশি। সেটাই মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম। এই অল্প সময়ে যা দেখলাম যতটুকু বুঝলাম তার সাথে মাসিমার, বাবার গল্পের কোন পার্থক্য পাইনি। যার সাথে কথা হয়েছে মনে হয়েছে যেন কত পরিচিত। আলাপে আন্তরিকতার অভাব বোধ হয়নি। নেই ধর্মের বর্ণের কোন ভিন্নতার ছোঁয়া। এখানে ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মনেই হলো না। আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক গাড়ির ড্রাইভার ছিল আলী। অল্পক্ষণেই অতি পরিচিত হয়ে উঠল। প্রথম ঢাকায় এসেছি শুনে তার আগ্রহ অধিক। দিদি এবং দাদা ডাকতে তার পছন্দ। আমাদের কোন আপত্তি ছিল না। আমরা কি কি দেখতে চাই, কি খেতে ভালোবাসি, কোন বাজারে কি ধরনের জিনিস পাওয়া যায় মুহূর্তেই আমাদের জানিয়ে দিল। আলীর আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে তৈরি হয়েছে হাতিরঝিল। আলি আমাদের এই হাতিরঝিল দেখাতে নিয়ে গেল। কি অপূর্ব সৌন্দর্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। আমি ভারতের অনেক শহরে ঘুরেছি কিন্তু এমনটি আমার কোথাও নজরে আসেনি। এর নির্মাণ কৌশল নগরের সৌন্দর্য বর্ধনে বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে।
রাতে আরেফিন সাহেবের বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠান। দূতাবাস কর্মকর্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তির সমাবেশ। বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপিসহ উপস্থিত ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ। সস্ত্রীক ভারত থেকে উপস্থিত ছিলেন টেকনো ইন্ডিয়ার কর্ণধার শ্রী সত্যম রায় চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। অনুষ্ঠানটি ছিল একটি মিলন মেলা। পরিচিত হলাম অনেকের সাথে। সকলের আন্তরিকতা আমাদের কাছে স্মরণীয়।
পরদিন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে কাছের একটি মার্কেটে গেলাম। এটি গুলশান ১ ডিআইটি মার্কেট হিসাবে পরিচিত। সমস্ত মার্কেটটি বিদেশি পণ্যে ভর্তি। পৃথিবীর সকল দেশের পণ্য একটি ছাদের নিচে। পছন্দের টুকিটাকি কেনাকাটা হলো। ঢাকার রিকশা দেখতে খুব সুন্দর। কারুকার্যে ভরা। কিছুক্ষণ রিকশায় চড়ে হোটেলে ফিরলাম।
আনন্দঘন পরিবেশে বিকেলের মূল আলোচনা অনুষ্ঠানটি ছিল আমার জন্য স্মরণীয়। মঞ্চে মন্ত্রী, এমপি, গবেষক, সাহিত্যকদের সাথে আমিও একজন। সকলের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ছিল আরেফিন সাহেবের গবেষণা কর্ম নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে অনেকের সাথে পরিচিত হলাম। কলকাতা থেকে এসেছি জেনে অনেকে ছবি তুলতে আগ্রহী। আমার কর্মস্থল সংবাদ সংস্থা ভি-নিউজের সম্পাদক জয়ন্ত আচার্য এই অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক। তিনি অনেকের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমি সুযোগমতো অনেক সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের উত্থান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের বিষয় জানতে চেষ্টা করি। এই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকায় অনেক সংবাদ দেখা যায়। কিন্তু ঢাকায় এই স্বল্প সময়ের অবস্থান এবং দুটি অনুষ্ঠানে ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি আমার ধারণাকে অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। আলোচনায় অনেকের মতামত ছিল এটি অনেকাংশে রাজনৈতিক বক্তব্য। বাস্তবে বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। উগ্র মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদের উত্থান বিষয়টি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অনেকে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ দেখে অনেকে বলেন, বাংলাদেশকে জানতে হলে পহেলা বৈশাখ বা দুর্গাপূজার সময় আসুন। বাঙালির নিজস্বতা ধর্ম-বর্ণের কত ঊধর্ে্ব বিষয়টি দেখতে পাবেন। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ১০০০ অধিক পূজা ম-ব তৈরি হয়। প্রতিটি পূজা ম-প যেন একেকটি মিলন ক্ষেত্র। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি না দেখলে বাংলাদেশকে চেনা যাবে না। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা তুলনাহীন। অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ধর্ম-বর্ণ মিলে মিশে যেখানে একাকার হয়ে যায় সেটাই হলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমার জানার আগ্রহ অনেকদিনের। দেশ ভাগের ওপর অনেক বই পড়েছি, অনেকের বিশ্লেষণ শুনেছি। কিন্তু কোন দিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়নি। একজন সাংবাদিক হিসাবে এতদিন যা শুনেছি বা বিভিন্ন মাধ্যমে যা পড়েছি বাংলাদেশে এসে আমার সকল ধারণা পাল্টে গেল। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা থেকে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিটি স্তরে সকল ধর্মের ব্যক্তির অবস্থান দৃশ্যমান। এখানে বাঙালি পরিচয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। আমার স্বল্প পরিসরে দেখা অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারকে কেন্দ্র করে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে সে রাষ্ট্র হয়তো কোনদিন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হবে না।
[লেখক: সাংবাদিক, কলকাতা করসপন্ডেন্স, ভি-নিউজ, বাংলাদেশ]