এমদাদুল মল্লিক হুইলচেয়ারে বসা। দুই পা পুরোপুরি অবশ। উপরন্তু কাঁধ থেকে হাত দুটোও নেই। তবু থেমে নেই মল্লিক। ঠোঁট আর দাঁতে চেপে ধরা তুলি। ঘাড় ও মাথা ঘুরিয়ে বারবার রং নিচ্ছেন আর ছবি আঁকছেন। হুইলচেয়ারের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় লাগানো ক্যানভাস। তুলির টানে তাতে ফুটে উঠছে গাছ, গরু, মানুষসহ নিসর্গের ছবি। এভাবে আঁকা ২৩টি ছবি নিয়ে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হলো এমদাদুল মল্লিকের একক প্রদর্শনী।
প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) এমদাদুল মল্লিকের এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। গত শুক্র ও শনিবার প্রদর্শনীটি হয়েছে বনানীর লীলা গ্যালারিতে।
লীলা কর্তৃপক্ষ এই আয়োজনের জন্য গ্যালারির কোনো ভাড়া নেয়নি। এমদাদুল মল্লিককে তাঁর বাড়ি নওগাঁ থেকে (সঙ্গে একজনসহ) ঢাকায় আনা, তাঁর ছবি বাঁধাই করাসহ সব কাজ করেছে পিডিএফ। প্রদর্শনীতে ছবি বিক্রির অর্থের একটি অংশ যাবে পিডিএফের বৃত্তি তহবিলে। একটি অংশ লীলা গ্যালারি পাবে। আর বাকি টাকা পাবেন শিল্পী নিজে। তাঁর ছবির দাম ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
গতকাল গ্যালারিতে আলাপে এমদাদুল জানালেন, তাঁর দুই হাত ছিল। সচল ছিল পা। বাড়ি নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম বালুবাজারে। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। কাজ করতেন দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে। ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। পরে যাঁরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন, তাঁরাই তাঁর নামের সঙ্গে ‘ইব্রাহিম’ নামটি যোগ করে দেন। এখন তাঁর নাম এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিম। তারপর থেকে ‘ইব্রাহিম’ নামটিই পরিচিত হয়ে গেছে। আঁকা ছবির নিচেও ইব্রাহিম নামেই সই করেছেন।
এমদাদুল জানালেন, দুর্ঘটনার পর স্থানীয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা নেন দীর্ঘ আট বছর। চিকিৎসার খরচ বহন করেছে তাঁর পরিবার। কর্মস্থল থেকে এক মাসের বেতন ছাড়া আর তেমন কোনো সহায়তা পাননি।
সিআরপিতে থাকা অবস্থায় এমদাদুল সবার কাছে শুনেছেন, লাভলী নামের এক প্রতিবন্ধী মুখ দিয়ে ছবি আঁকতেন। লাভলীর গল্প শুনেই অনুপ্রেরণা। তারপর সিআরপির সার্বিক সহায়তায় শুরু হয় মুখ দিয়ে ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ।
এমদাদুল বলেন, ‘প্রথম দিকে ছবি আঁকতে বসলে মাথা ঘুরত। বমি করতাম। এখন আর সমস্যা হয় না। প্রাকৃতিক দৃশ্যসহ এ পর্যন্ত দেড় হাজার ছবি আঁকছি। প্রায় সবই বিক্রি হইয়া গেছে। এ ছাড়া আমি মুখ দিয়া কম্পিউটারও চালাইতে পারি।’ এমদাদুল জানালেন, সিআরপিতে থাকা অবস্থায় আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের মাধ্যমেই তাঁর ছবি আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি হচ্ছে।
এমদাদুলের বয়স প্রায় ২৫ বছর। শরীরের খুব সামান্য একটু অংশ শুধু সচল। এখন দৈনন্দিন কাজ ও ছবি আঁকায় সহায়তা করেন তাঁর অসুস্থ মা। থাকেন বড় ভাই ও ভাবির সঙ্গে। ছবি বিক্রির টাকা থেকে সংসারের খরচ দেন তিনি। জন্মের আড়াই বছর বয়সে বাবা মারা যান। মায়ের অবর্তমানে কী হবে ভেবে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না তিনি। এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছেন। তবে দুই হাত নেই শুনে কেউ আগ্রহ দেখায় না।
পিডিএফের ভাইস চেয়ারম্যান মামুনুর রশীদ বলেন, এমদাদুলের ছবি আঁকার যে দক্ষতা, তা প্রচার করার জন্যই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস সাজানোর ক্ষেত্রে আঁকা ছবিকে প্রাধান্য দেয়। এমদাদুলের ছবি যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো কেনে, সে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।