আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাফল্য

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ বাংলাদেশ ও বিশ্বের কাছে একটি আস্থার সংস্থায় পরিণত হয়েছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষী হাজির করা এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় প্রদান ও সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মামলা পরিচালনায় নির্ভীক থাকায় ট্রাইব্যুনালের সব সদস্য প্রশংসা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে রায় কার্যকর করার সময় শেখ হাসিনা সরকারকেও বিচিত্র চাপ সামলাতে হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ- পাওয়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ১৮ নভেম্বর তাদের ফাঁসির রায় ঠেকাতে পাকিস্তানকে সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের আমির সিরাজুল হক। অন্যদিকে পৃথিবীর ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিরাও অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করেন। ভয়ভীতি, চাপ উত্তীর্ণ হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রায় ঘোষণা এবং রায় কার্যকর করার সাফল্যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উদ্ভাসিত নক্ষত্র।

৮ মার্চ (২০১৬) যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আরও একটি সাফল্য দেখল সারা বিশ্ব। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সাজা বহাল থাকল একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম আলীর। তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হবে। এই ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামীর পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষের করা রিভিউ আবেদন এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আর সর্বশেষ রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হলে দ- কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করবে কারা কর্তৃপক্ষ। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিল আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার জোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে শক্ত ভিত্তি। ষোলো মাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদ- এবং আট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদ- হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়। একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হয়।

পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়। ১৯৮০ সালে মীর কাসেম যখন সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন হলে মীর কাসেম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হয়। দলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে হয় জামায়াতের শূরা সদস্য। ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর কাজ শুরু হয়। একইদিন যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২৩ সেপ্টেম্বর একই অভিযোগে সুবহানকে আটক করেন আদালত।

২০১৩ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে গতিশীল কার্যক্রমের বছর। এ বছর ২১ জানুয়ারি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর পলাতক নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন একই আদালত। যদিও পরে আপিলে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি একই দলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অবশ্য পরে আপিলে এই অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। ৯ মে জামায়াতে ইসলামীর অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- দেন আদালত। ১৭ জুলাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ১ অক্টোবর একই অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদ- দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের মামলায় দোষ স্বীকার করে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সাজা কমানোর আবেদন করেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়। ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুস সুবহানকে ফাঁসির আদেশ দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একইদিন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-ে দ-িত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ২০১৫ সালের ৯ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল-২। ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের কসাই রাজাকার কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদ- ও খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলবদর কমান্ডার জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নেত্রকোনোর দুই রাজাকার ওবায়দুল হক ওরফে তাহের ও আতাউর রহমান ওরফে ননীকে ফাঁসির দ- দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ কেবল একাত্তরের অপরাধের জন্য দ- প্রদান করেননি বিচারের সম্মুখীন করেছেন অনেক ব্যক্তিকে। সংস্থাটির দায়িত্ব এবং কর্তব্যের পরিধিও বেড়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার রাঢ়িপাড়া ইউনিয়নের সোলারকোলা গ্রামের বাড়ি থেকে আবদুল লতিফ তালুকদারকে (৭৫) গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১২ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে শুনানি শেষে আবদুল লতিফ তালুকদারকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আকরাম খানকে রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড গোলাম আযমের মৃত্যু ঘটে। ১১ ডিসেম্বর একাত্তরে ৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মাহিদুর রহমান ও মো. আফসার হোসেন চুটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দুই আসামি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার খাগাউড়া ইউনিয়নের কুমুরশামা গ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মহিবুর রহমান বড় মিয়া ও তার ছোট ভাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান আঙুর মিয়াকে গ্রেপ্তার করে হবিগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশ। ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাদ-াদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তরিতকরণ এবং বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ৫টি অভিযোগে এই দ-াদেশ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১ মার্চ কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মোহাম্মদ রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২ মার্চ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ছয় অভিযোগে নেত্রকোনার মো. ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ৩ মার্চ গ্রেপ্তার জামালপুরের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শামসুল হক ও এসএম ইউসুফ আলীকে কারাগারে পাঠান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল জামালপুরের আট রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন প্রসিকিউশন। ১২ মে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যশোরে ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের নিকলি থানার সৈয়দ মোহাম্মদ হোসাইন ও মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ১২ আগস্ট নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা থেকে আবদুর রহমান ও আহমদ আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

একইদিন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মওলানা আবদুল খালেক ম-লকে শ্যোন-অ্যারেস্টের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল। ৭ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউনিয়নের সলেমান মৃধা, গনি হাওলাদার, আউয়াল মৌলভী, ইসাহাক সিকদার ও সত্তার প্যাদা এই পাঁচ যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। ৮ সেপ্টেম্বর যশোরের সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার আসামিরা হলেনÑ মো. সাখাওয়াত হোসেন, বিল্লাল হোসেন, মো. আকরাম হোসেন, ওজিহার মোড়ল, মো. ইব্রাহিম হোসেন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, মো. আবদুল আজিজ সরদার, আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম, লুৎফর মোড়ল, আবদুল খালেক মোড়ল ও মশিয়ার রহমান। ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় পার্টির এমপি আবদুল হান্নানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৫ অক্টোবর নোয়াখালীর রাজাকার আমির আহম্মদ ওরফে আমির আলীকে (৬৯) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৭ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আনিসুর রহমান মানিকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে এবং হবিগঞ্জে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মো. সফি উদ্দিনসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২৬ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে মৌলভীবাজারের মাওলানা আকমল আলী তালুকদারকে (৭৩) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৬ নভেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) জামায়াত নেতা আবদুল আজিজসহ (৬৫) ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা এএসএম রেজাউল হক (৭০) ওরফে আক্কাস মৌলভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১০ ডিসেম্বর মো. ইউসুফ আলী ওরফে একেএম ইউসুফ আলমকে (৫৮) আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৮)। ১৩ ডিসেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলের এমদাদুল হক ওরফে টাক্কাবালীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৮ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার পলাতক আসামি আবুল কালাম মনসুর ওরফে একেএম মনসুরকে গ্রেপ্তারের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়া প্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ‘গণহত্যায় দায়ীরা এখন কাঠগড়ায়’ শীর্ষক এক নিবন্ধে (সমকাল, ৯ মার্চ, ২০১৬) যুদ্ধাপরাধের বিচারে জনসমর্থনের কথা উল্লেখ করেছেন। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৯ শতাংশ মানুষ চান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকুক। তার মতে, ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া জনগণ ন্যায়বিচারের এই সংগ্রামে আস্থা রেখেছেন। মূলত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক। এটি গঠন করা হয়েছে বৈশ্বিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত রোম স্টাটিউটের কাঠামো অনুসারে। ফলে এই বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। যে কেউ গিয়ে বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। উপরন্তু বিশ্বে বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনালই একমাত্র যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল, যেখানে বিবাদীরা বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারে।

‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ নিজেদের মর্যাদার ব্যাপারেও সতর্ক। ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় আদালত অবমাননার দায়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে জরিমানা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। সাজা হিসেবে রায় ঘোষণার দিন তাকে ট্রাইব্যুনালে পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেই সঙ্গে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অবশ্য ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি আদালত অবমাননার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বার্গম্যানের বিষয়ে বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ১৪ জন তাদের বিবৃতির জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চান। অন্যদিকে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের রায়ের বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের করা মন্তব্য আদালত অবমাননাকর উল্লেখ করে তাদের তলব করেছেন সুপ্রিমকোর্ট। ৫ মার্চ (২০১৬) রাজধানীর বিলিয়া মিলনায়তনে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ আয়োজিত গোলটেবিলে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেম আলীর আপিলের পুনরায় শুনানি চেয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে পদ ছাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’কে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে রাতদিন পরিশ্রম করতে হচ্ছে। সেখানে তাদের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না। বরং তাদের সাফল্যে আজ আমরা গৌরবান্বিত।

লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়