নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর গত ৯ মাসে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে কয়েক দফা বৈঠক, চিঠি চালাচালি ও বিস্তর আলাপ-আলোচনা শেষে গতকাল বুধবার ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় আরো ২০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে সই করেছে সরকার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (এক ডলার=৭৮ টাকা) বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এযাবত্কালের এটিই সবচেয়ে বড় ঋণচুক্তি। ঋণ দিয়ে দেশের সড়ক, রেল, নৌসহ কারিগরি ও সামাজিক খাতের আপাতত ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ঋণচুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন। আর ভারতের এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক যাদবেন্দ্র মাথুর। এ সময় অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আসিফ উজ জামানসহ দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত বছর জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ঘোষণার ৯ মাস পর অবশেষে দুই দেশের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন হলো।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি শুধু অর্থ বিনিময় নয়, বরং এ ঋণচুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হলো। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ভালো চলছে বলেও মত দেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। ভারতীয় ঋণে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সহজ হবে, অন্যদিকে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর হবে বলেও অভিমত তাঁদের।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক যাদবেন্দ্র মাথুর বলেন, এক্সিম ব্যাংকের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় ঋণচুক্তি। এই ঋণ চুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ হলো বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের মধ্যে চমত্কার সম্পর্ক বিরাজ করছে। এক্সিম ব্যাংক ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বের ৬৩টি দেশকে সহজ শর্তে ২৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। গত ১৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্যই সর্বোচ্চ ঋণের আকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে ইআরডির সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন বলেন, প্রথম দফায় ১০০ কোটি ডলার ঋণে যেসব শর্ত ছিল, ২০০ কোটি ডলার ঋণ ব্যবহারেও একই শর্ত বহাল থাকবে। তিনি বলেন, ‘২০০ কোটি ডলার ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে বাংলাদেশ এই অর্থ পরিশোধ করতে পারবে’। এ ছাড়া ২০০ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে কমিটমেন্ট ফি ধরা হয়েছে ০.৫০ শতাংশ।
এক প্রশ্নের জবাবে ইআরডির সিনিয়র সচিব বলেন, ২০০ কোটি ডলার ঋণের আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যত ধরনের পণ্য, উপকরণ ও যন্ত্রপাতি কেনা হবে তার ৭৫ শতাংশ আনতে হবে ভারত থেকে। আর বাকি ২৫ শতাংশ অন্য দেশ থেকে নেওয়া যাবে। তবে পূর্তকাজ বিশেষ করে ইট, বালি, রড-সিমেন্টের মতো নির্মাণ প্রকল্পে ভারত কিছুটা ছাড় দিয়েছে। তাতে ৬৫ শতাংশ পণ্য ও উপকরণ ভারত থেকে আনা যাবে। আর বাকি ৩৫ শতাংশ অন্য যেকোনো দেশ থেকে নেওয়া যাবে।
মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার নিয়োগ হবে ভারত থেকে। সেখানে বাংলাদেশের কোনো ঠিকাদার অংশ নিতে পারবে না। তবে ভারতীয় ঠিকাদারদের থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আসিফ উজ জামান বলেন, এ ঋণের আওতায় ভারতীয় শ্রমিক ও কর্মকর্তারা যাঁরা বাংলাদেশে কাজ করতে আসবেন, তাঁদের আয়কর দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে শুধু ঋণই নিচ্ছে না, অন্যান্য খাতেও সম্পর্ক উন্নয়ন হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, দুই দেশের মধ্যে রামপাল মৈত্রী বিদ্যুেকন্দ্র বাস্তবায়ন হতে চলেছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ২০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি মানে অর্থ বিনিময় নয়, বরং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হয়েছে। এ ঋণের আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের জীবনযাত্রা ও জীবনমান আরো উন্নত হবে আশা করেন তিনি।