কৌশিক বসুর বক্তৃতায় আমাদের অর্থনীতি

বাংলাদেশে এসে বক্তৃতা করে, সরকারপ্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে, সংবাদপত্রে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে বিশেষত অর্থনীতি নিয়ে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার পর শিক্ষিত সর্বস্তরের মানুষ আশা করা যায় তাকে এখন চেনে এবং মনে রাখবে। ভারত ও ব্রিটেনে অর্থশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার পর, সুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে ও ভারত সরকারের সঙ্গে কাজ করে অতঃপর তিনি যখন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দিলেন, তখন আমরা যারা অর্থশাস্ত্রের ছাত্র এবং নিজ নিজ পেশায় থেকে অর্থনীতির খোঁজটা আলাদা করে রাখি, তারা খুশি হয়েছিলাম এ বাঙালি অর্থনীতিবিদের প্রতিষ্ঠা দেখে। এও ঠিক, তিনি এখন কিছু বললে তাতে ওই সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হবে, নিদেনপক্ষে সেটার বিরুদ্ধে যাবে না। বাংলাদেশ সফরে এসে কৌশিক বসু যা যা বলে গেছেন, সেটাকে ওই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করে দেখতে হবে।
তিনি ধারণা দিয়েছেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষত গত ৫-৭ বছরে এ দেশের অর্থনীতি অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভালো করছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬-এর বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে আর একই সময়ে এটা বিশ্বের বহু দেশ অর্জন করতে পারছে না। অনেকেই প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন। কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে এটাও দেখাতে পারবেন যে, প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হওয়ার কথা। সে বিতর্কে না গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যে হিসাবটা দিচ্ছে, সেটা মেনে নেওয়াই ভালো। রাশিয়ার অর্থনৈতিক রূপান্তর বিষয়ে লেনিনের কিছু লেখা পড়ার সময় দেখেছি, তিনি জার সরকার পরিবেশিত তথ্য-পরিসংখ্যান ধরেই আলোচনা করছেন। পরিসংখ্যানগত ত্রুটি কিছু থাকে বৈকি; কিন্তু তাতে সত্যটা উল্টে যায় না।

এ অবস্থায় কৌশিক বসুর ওই মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ যে, সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এখন কম দেশেই হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা তো এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এর প্রভাবে বেশ কিছু দেশে, তার মধ্যে উন্নত অর্থনীতির দেশও রয়েছে_ সেখানে এমনকি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব প্রাক্কলন হলো, আগামী বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা কিনা গণচীনের সমান। চীনের অর্থনীতিতে এত বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল যে, ওটাকে বলা হতো ‘ওভার হিটেড ইকোনমি’। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ওটা এখন কমে বা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেড়ে সেটা পাল্লা দিতে লাগছে চীনের সঙ্গে। অনেকে মনে করতে পারেন, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসে এখানকার অর্থনীতির একটা ‘রোজি পিকচার’ তিনি তুলে ধরেছেন বিশেষ কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করতে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে তার ওই সফর কিনা, এ প্রশ্ন অনেকের মনে উঠেছে। কিন্তু কথা হলো, ইতিমধ্যে পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতেই বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। আর এগুলো বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের মূল্যায়নের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।

হতে পারে, একজন বাঙালি অর্থনীতিবিদ হিসেবে এ পদে যোগদানের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি দেশে এসে এর উন্নতির দিকটি নিয়ে তিনি একটু উচ্ছ্বসিত। এ অনুমান সত্য হয়ে থাকলেও বলতে হবে, এটা তো ‘মানবিক বিচ্যুতি’। লোক বক্তৃতায় তিনি কিন্তু এমনটাও বলেছেন, কিছু শর্ত পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব। বেসরকারি খাতের ভূমিকা বেড়ে যাওয়ার ফলেই মূলত এখানে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হয়েছে। কৃষির তুলনায় শিল্প-ব্যবসা ও সেবা খাতের ভূমিকা বেড়ে যাওয়াতেও ঘটেছে এটা। এর অনিবার্য পরিণতিতে দেশে নগরায়নের হার বেড়েছে। মানুষের চাপে শহরাঞ্চলে আবার অবনতি ঘটেছে সার্বিক জীবনযাত্রার। পরিবেশগত বিপর্যয়ও হয়ে উঠেছে রূঢ় বাস্তবতা। রাজধানীসহ কোনো কোনো নগরীতে যানজট পরিস্থিতি মোকাবেলায় অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারকে বাড়াতে হচ্ছে বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগ এ দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে, যদিও দুর্নীতিসহ নানা কারণে এর মান নিয়ে রয়ে গেছে প্রশ্ন। প্রকল্পের মানহীন বাস্তবায়নের ফলে এ থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না জনগণ ও অর্থনীতি। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে এ সময়ে সবচেয়ে বড় প্রকল্প যেটি বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা হলো পদ্মা সেতু। এর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে গোল বেধেছে বলেও এখন সরকারের বড় দায়িত্ব হলো এর বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা। স্বভাবতই এ নিয়ে বেশি কথা বলেননি কৌশিক বসু; প্রশ্ন করা হলেও বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। তবে সার্বিকভাবে দুর্নীতি, দেশ পরিচালনার মান তথা সুশাসন নিয়ে কথা বলতে ছাড়েননি। আর এটি যে বাংলাদেশের একচেটিয়া সমস্যা নয়, সেটাও বলেছেন।

দামের বিষয়টিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হলে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির একটা বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে এরই মধ্যে গৃহীত বা বাস্তবায়নাধীন কয়েকটি ‘মেগা প্রজেক্ট’ আস্থা ও উৎসাহ জোগাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মনে। এর প্রভাবে বিদেশি বিনিয়োগ জিডিপির কত থেকে কত শতাংশে উন্নীত হতে পারে, সে বিষয়েও ধারণা দিয়েছেন মি. বসু। আমরা জানি, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থা জাগলে এবং তারা নিজ অর্থনীতিতে বিনিয়োগে এগিয়ে এলে তবে বিদেশিরাও উৎসাহী হন। বিশ্বের কোথাও কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশে এখনও নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে বিদেশিরাও মনে করছেন। এ অবস্থায় অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের বাধার দিকগুলো স্বভাবতই বেশি গুরুত্ব পাবে। নির্দিষ্ট সময়ে পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এবং এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে তা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে বৈকি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এতে উৎসাহিত হবেন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পালেও হাওয়া লাগবে। ৭ শতাংশ ও তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখছি আমরা অনেকদিন ধরে। বাজেটে সে ধরনের লক্ষ্যমাত্রাও ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রী, যদিও তা অর্জিত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে, ৭ অতিক্রম করতে পারলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে পেঁৗছতে বেশি সময় লাগবে না। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, অর্থনীতিতেও তেমনি কিছু বাধা অতিক্রম করা সুকঠিন হয়ে পড়ে। সেজন্য বিশেষ প্রচেষ্টা নিতে হয়; হয়তো পূরণ করতে হয় নতুন কোনো শর্ত। পদ্মা সেতু কি রয়েছে এর মধ্যে? কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠীর সহজ শর্তের ঋণে এটি সম্পন্ন করা গেলে আমাদের জন্য ভালো হতো। এত বড় একটি প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট থাকতে না পেরে তারাও ব্যথিত নিশ্চয়ই? তবে এতে করে স্থানীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতির যে ‘ইন্টিগ্রেশন’ ঘটবে, তার মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী নতুন নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবে না বিশ্বব্যাংক।

এরই মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটি পত্রিকার সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা কিন্তু উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কৌশিক বসু যে সেটা আড়াল করেছেন, তা নয়। তিনি লক্ষ্য করতে ভোলেননি, এখানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির হারও একটা স্তরে গিয়ে আটকে আছে। ভারতের অর্থনীতিতেও নাকি গেছে এমন একটা পর্যায়। সেটি কেটে যাওয়ার পর ওখানে প্রবৃদ্ধিও বাড়তে শুরু করে উল্লেখযোগ্যভাবে। এদিকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার অব্যাহত রয়েছে এবং সম্প্রতি এ বিষয়ে মিলেছে উদ্বেগজনক খবর। এতে পরিবেশিত তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বেসরকারি খাতে বেড়ে চলা সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে আশানুরূপভাবে বিনিয়োগ বাড়তে না থাকার বাস্তবতাটি এর এক ধরনের স্বীকৃতি দিচ্ছে বৈকি। কর প্রশাসনের কড়াকড়িতেও পুঁজি পাচার বেড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। জননিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতিকেও এজন্য দায়ী করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ এ মুহূর্তে একটা ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনে’ পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু কৌশিক বসু দেখাচ্ছেন, এর চেয়ে বেশি কেন্দ্রীভূত আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ বলতে আমরা কী বুঝব, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েই যাচ্ছে। তবে প্রচলিত ধরনের উন্নয়নের স্বাভাবিক সুফলও এ দেশের মানুষ পাচ্ছে না, তা চট করে বলে দেওয়া যাবে কী? দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন কিন্তু এটা বলে না। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে প্রায় ধারাবাহিক অগ্রগতিও এটি বলছে না। কৌশিক বসু দেখি বারবার বলছেন, জীবন ও অর্থনীতি কোনোটাই ‘জিরো সাম গেইম’ নয়। একজন বা একপক্ষ সব পাচ্ছে আর অন্যপক্ষ কিছুই পাচ্ছে না, বিষয়টা কখনোই এমন নয়। তবে কে কতটা পাচ্ছে, সেটা বিচার করে দেখাও জরুরি। বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা নয়; কল্যাণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা মানুষদেরই সেটা বিবেচনা করে দেখতে হবে।

সাংবাদিক ও কলাম লেখক