পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে অদম্য বাঙালী জাতি ঘুরে দাঁড়ায় বার বার

হাজার বছর আগে থেকেই এই বাংলা ছিল বিদেশী বেনিয়াদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে বণিকরা এখানে ছুটে এসেছিল ব্যবসা করতে। বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম ছিল তাদের বড়ই পছন্দের। ব্যবসা করা মূল লক্ষ্য হলেও এই বাংলার সমৃদ্ধি ও ভৌগোলিক অবস্থান একপর্যায়ে তাদের প্রলুব্ধ করে কর্তৃত্ব স্থাপনের। এদেশ বার বার পরাধীন হয়েছে, আবার সে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তও হয়েছে এই অদম্য জাতি। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির শতবর্ষ উদযাপন উৎসবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম বন্দর স্টেডিয়ামে বর্ণিল আলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় হাজার বছরের ইতিহাস, যা অভিভূত করে দর্শনার্থীদের।

চট্টগ্রাম বন্দর স্টেডিয়ামে ‘হিস্টোরি এ্যান্ড হ্যারিটেজ অব চিটাগং ইন লাইট এ্যান্ড সাউন্ড’ নামের এ প্রদর্শনীতে বর্ণিল আলোকছটায় উঠে আসে হাজার বছর। দেখতে দেখতে দর্শকরা ফিরে যান সুদূর অতীতে। এই চট্টগ্রামে নির্মিত যুদ্ধজাহাজ গিয়েছিল জার্মানিতে। এখনও তা সংরক্ষিত আছে জার্মান জাদুঘরে। এসব জানতে পেরে হতবাক হন অনেকেই। চিটাগং চেম্বারের এ আয়োজন ছিল নিজের অতীত ও সমৃদ্ধিকে তুলে ধরে জনগণকে ফের জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।

প্রদর্শনীতে একের পর এক দেখানো হয় কিভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল চীনা, পর্তুগীজ, মোগল ও ইংরেজ বণিকরা। আরব ও মোঘলদের আগমনও দেখানো হয় বিশেষভাবে। সেই তুলে ধরার মধ্যে রয়েছে অসাধারণ নৈপুণ্যের ছাপ, যা দর্শকদের বিমুগ্ধ করে ফেলে। প্রদর্শনীটি এতটাই চিত্তাকর্ষক হবে তা আগেভাগে কল্পনা করতে পারেননি কেউ। ফলে যারা দেখতে পারেননি তাদের আফসোস থেকেই যায়।

অনুষ্ঠান শুরু হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, দইজ্জার কুলোত বসত গরি আঁরা সিনা দি ঠেগাই ঝড় তুফান’ গান দিয়ে। সুরে সুরেই উঠে আসে প্রাচীন চট্টগ্রামের চিত্র। সাদা পোশাক পরিহিত আরব বণিকরা প্রবেশ করে চট্টগ্রামে। এরপর অন্যান্য দেশের বণিকদের আগমনও ভেসে উঠে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর ধারা ভাষ্যকার তুলে ধরেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন নামের পরিচিতি। পোর্টোগ্রান্ডে, ইসলামাবাদ, চাটিগাঁ, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম কিভাবে হলো সেটিও উঠে আসে বর্ণনায়। হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেন লাইট এ্যান্ড সাউন্ড তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্রে স্থান পায় ব্রিটিশ শাসন ও পাকিস্তানী দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের ধাপগুলো। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় উপস্থাপিত হয় অসাধারণ নিপুণতায়। বিমোহিত দর্শককূল আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেন। তারা অতীত দেখেননি। কিন্তু এমন চিত্র তাদের নিয়ে গেছে সেই অতীতে। নিজেদের সমৃদ্ধির ইতিহাস দেখে তারা গর্বিত হন। উৎসব উদযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য এমএ লতিফ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, আজ থেকে ৪শ’ বছর আগে আমাদের চট্টগ্রামেই যুদ্ধজাহাজ তৈরি হয়েছিল। এখান থেকে যুদ্ধজাহাজ গেছে জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আজ তারা উন্নতির চরম শিখরে। আমাদের জানতে হবে নিজের অতীত। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানাতে হবে। আমরা মাঝে দীর্ঘ সময় পিছিয়ে থাকলেও এখন আবারও জাহাজ তৈরি করে বিদেশে রফতানি করছি। তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা সেই জাতি যারা বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আবারও দাঁড়াতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর স্টেডিয়ামে চেম্বারের লাইট এ্যান্ড শো অনুষ্ঠানে দর্শকরা দেখতে পেল ভিনদেশী জাহাজের বহর। দেখল চীনা, পর্তুগীজ, আরব, ব্রিটিশ ও বিভিন্ন ভিন জাতির আগমন। তাদের কারও শারীরিক গঠন সুঠাম, বিচিত্র পোশাক আবার কারও সঙ্গে রয়েছে ঢাল-তলোয়ার এমনকি ভারি কামান। আগন্তুক দেখে অনেকেই ভয়ে পালিয়েছে। আবার অনেকেই হয়েছে বিস্মিত। কেউ কেউ কাছে গিয়েছে। অনেকে প্রকাশ করেছে ঘৃণা আবার কেউ কেউ ব্যবহৃতও হয়েছে। নিজেকে হারানো এবং উদ্ধার পাওয়া দুটোই উঠে আসে চিত্রে। মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার, আরাকান রাজত্ব, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, এরপর মেদেনীপুর ও বর্ধমান অঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রামকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেয়াসহ কোন ইতিহাসই বাদ যায়নি এই তথ্যচিত্রে। উঠে আসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, ’৪৭ পরবর্তী সময়ের ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক এবং ১৬ ডিসেম্বর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে পাক অধিনায়ক নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। যারা দেখেছেন তারা একবাক্যে বলেছেন, এই এক অসাধারণ উদ্যোগ, যা অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে।