শরিফা খাতুন তখন পঞ্চম ও রেহানা খাতুন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। দুজনেরই বাবা-মা তাদের বিয়ে ঠিক করেন। সংসারের অভাব ও অসচেতনতার বলি হতে যাচ্ছিল সংগীত প্রতিভাধর মেয়ে দুটি। খবর জেনে ছুটে গেলেন বাদশা আলম। শরিফার বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীর বড় কমলাবাড়ি গ্রামে। রেহানার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরের মানুষ মারার চরে। দুজনের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করলেন তিনি।
বাদশা আলম রেহানাকে ২০০৮ ও শরিফাকে ২০০৯ সালে নিজের সংগঠন ‘আরশী নগর’-এর আশ্রয়কেন্দ্র ‘অচিন পাখি’তে থাকাখাওয়াসহ পড়ালেখার ব্যবস্থা করেন। রেহানা ২০১৩ ও শরিফা ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করে। তারা দুজনই এখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী।
শুধু রেহানা, শরিফা নয়, আরও অনেক সংগীত প্রতিভাধর শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন বাদশা আলম। ২০০৫ সালে লালমনিরহাট শহরের এলজিইডি রোডে আট শতক জমির ওপর সেবামূলক সংগঠন আরশী নগর বাংলাদেশ গড়ে তোলেন তিনি।
আরশী নগরের অচিন পাখিতে থেকে লেখাপড়া ও গান শিখছে শাহানুর, রিপন, আমেনা, রিপন কুমার, নিশি, বাঁশিসহ মোট ১০ জন শিক্ষার্থী। এই অসহায় ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলছে আরশী নগর। এ ছাড়া আরশী নগরের উদ্যোগে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় চলছে ১৮টি গুরুগৃহ। এই গুরুগৃহ চলে কোনো লোকশিল্পীর বাড়িতে। ওই শিল্পীই গুরু। তাঁর বাড়িতেই স্থানীয় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত গানের তালিম নেয়। ব্যবস্থাপনা আরশী নগরের।
এতে শুরু থেকেই অনুপ্রেরণা ও সহায়তা দিয়ে আসছেন নরওয়ের নাগরিক উয়েরা সেথের। আরশী নগরের উদ্যোগে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের ১ হাজার ২০০ শিশু লোকসংগীতশিল্পী এবং ৫৪ জন সংগীতগুরুর প্রতিভা বিকাশের সহায়তার অংশ হিসেবে ১২টি লোকসংগীতের সিডি প্রকাশ করা হয়েছে। দোতলা ভবনটিতে রয়েছে লোকসংগীত-সংক্রান্ত একটি সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহশালা, সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিও ইত্যাদি।
বাদশা আলমের নেতৃত্বে রেহানা, শরিফারা ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একাধিকবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে লোকসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সুনাম অর্জন করে। শরিফার জীবন ও সংগীত সাধনা নিয়ে ২০১৫ সালে নরওয়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হিলদে হ্যাগের নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র নরওয়ের বিভিন্ন শহরে প্রদর্শিত হয়েছে। একই বছর কনসার্ট নরওয়ের উদ্যোগে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে ‘বাংলা মিউজিক উইক’ অনুষ্ঠানে ৩৭টি দেশের শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। সেখানে আরশি নগরের শিল্পীরা চারটি গান পরিবেশন করে।
বাদশা আলম ও আরশী নগরের শিশুশিল্পীদের অংশগ্রহণে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র দ্য টেলস অব তিস্তা। এটি নির্মাণ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র পরিচালক অজয় রায়। সংগঠনটি সংগ্রহ করেছে উত্তরাঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় চার হাজার লোকসংগীত। এসব কাজের জন্য বাদশা আলম ইতিমধ্যে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা, সংবর্ধনা।
শরিফা বলে, ‘বাদশা আলম ও মা উয়েরা সেথের আমাদের দিকে না তাকালে আমরা এত দিন গ্রামবাংলার কুলবধূ, না হয় গার্মেন্টস কর্মী হয়ে যেতাম।’ রেহানা বলে, ‘আমরা লেখাপড়া শিখছি, দেশ-বিদেশে গান করছি, পরিবারকে সাহায্য করছি আর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখছি।’
বাদশা আলমের কথা: বাড়ি লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ি ইউনিয়নের সাদেক নগরে। বাবা নওশের আলী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বাদশা আলম মাত্র ২৭ দিন বয়সে মাকে হারান। দুধমা আলেয়া খাতুন তাঁকে লালনপালন করেন। তাঁর মুখে শোনা লোকসংগীতের পঙ্তিমালা বাদশাকে শিশু বয়সেই আকৃষ্ট করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বাদশার সংগীত প্রতিভা নজর কাড়ে রংপুর অঞ্চলের লোকসংগীতশিল্পী ও গীতিকবি নীলকমল মিশ্রের। এই নীলকমল মিশ্র আরশী নগরের সভাপতি।
বাদশা আলম ১৯৯৪ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৯৫ সালে সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে সাদেকুল আলম ও নওশিন আলম নামে দুই সন্তান রয়েছে। তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি সংগীতচর্চা করছে।
নীলকমল মিশ্র বলেন, ‘আমি শিক্ষকতা জীবনে বাদশাকে যেমন গানের জন্য উতলা দেখেছি, এখনো তেমনি দেখি। তার মতো মানুষদের কারণেই বাংলাদেশের লোকসংগীত এখনো বিলুপ্ত হয়নি।’
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, আরশী নগরের মাধ্যমে একদিকে লোকসংগীতের চর্চা হচ্ছে, অন্যদিকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে আগামী প্রজন্ম বেঁচে থাকার শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা পাচ্ছে।
উয়েরা সেথের জানালেন, ‘আমি ২০০২ সালে উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও দুঃখ-কষ্ট দেখতে আসি। আমি দেখতে পাই, চরাঞ্চলের লেখাপড়া না জানা অনেক মানুষ মুখে মুখে গান তৈরি করে, গায়। এসব আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তখন ভাবি, তারা তো বয়সী, মরে যাবে, তাদের সঙ্গে গানগুলোও মরে যাবে। গানপাগল বাদশা আলম আমার এ চিন্তার সঙ্গে একমত হয়। সে আমাকে বলে, “আমরা সংগঠন করব। এ গানগুলো আমরা শিশুদের শিখিয়ে দেব।” সেই ভাবনা থেকেই আরশী নগর আর গুরুগৃহগুলোর জন্ম হলো।’
বাদশা আলম বলেন, ‘পৈতৃক ৬০ শতক জমি বিক্রি করে শহরে একটি বাড়ি কিনি এবং তাতে ২০০৫ সালে আরশী নগর প্রতিষ্ঠা করি। দেশি-বিদেশি দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে অচিন পাখি নামে দুটি কক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের চারজন ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ছয়জন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া ও সংগীতচর্চা করছে। এদের এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে এরা ভবিষ্যতে আরশী নগরসহ লোকসংগীতচর্চার ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলার ছাটহর নারায়ণ গ্রামের গুরুগৃহ প্রাঙ্গণে লোকসংস্কৃতির গবেষক নরওয়ের নাগরিক উয়েরা সেথেরের উপস্থিতিতে সংগীতচর্চা করছে শিশুরা। সম্প্রতি তোলা ছবিএসেছে বাধাবন্ধ: ২০১১ সালে আদিতমারী উপজেলার মধুপুর গ্রামে গুরুগৃহে শিশুদের নিয়ে সংগীতচর্চা করার সময় একদল মৌলবাদী সংগীতচর্চা হারাম দাবি করে বাদশা আলম, উয়েরা সেথেরসহ অন্যদের ওপর হামলা চালায়। সে সময় পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে লালমনিরহাটে পৌঁছে দেয়। এরপর আরেকবার সন্ত্রাসীরা সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধের চেষ্টা করেছিল।
আরও কী করতে চায় আরশী নগর: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লোকসংগীতচর্চা এবং এর প্রসারের জন্য একটি এফএম রেডিও প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শিশু ও বৃদ্ধরা নিরাপদে থাকতে পারবেন। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার লোকসংগীতশিল্পীদের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে চায় আরশী নগর।