বড়ো খবর, বসে আঁকলো চার হাজার শিশু

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর প্রশ্নমুখর আক্ষেপ বুঝি আরও বেশি আমাদের ধাওয়া করবে। সামান্য স্পর্শ দিয়েই বাঙালি মধ্যবিত্তের শীতের আমেজ উধাও। বড়োজোর তিনদিন ভোরে, সন্ধ্যায়, মাঝরাতে কনকনে হাওয়া বইল, তারপর দলছুট হয়ে কোথায় পালিয়ে গেল, কে জানে! বাংলার বিল-বাদাড়ে, সুন্দরবনের জলাঞ্চলে ভিসা পাসপোর্টহীন, নানাবর্ণের বিদেশি পরিযায়ী পাখিদেরও বিশেষ দেখা নেই। এ মরশুমে, তারা কোন মুলুকে ছুটল, কেন আর বঙ্গমুখী নয়, কেন শীত তার চেহারা বদলাচ্ছে, এসব জিজ্ঞাসা নেই? কারণ কি উষ্ণায়ন আর প্রকৃতির ওপর অপ্রকৃতিস্থ খবরদারি? সমাজের সচেতন অংশ কী কারণে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে এত উদাসীন? তাদের উদাসীনতা কেবল প্রকৃতিকে ঘিরে? মনে হয় না। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে চারপাশে যা কিছু ঘটছে, ছোটো বড়ো ঘটনা, হাসিখুশির উত্সব এর প্রায় সবই আমাদের ক্ষীণ দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনের কয়েকটি বড়ো, অতি উজ্জ্বল, ভবিষ্যত্মুখী, দিকদর্শী অথচ উপেক্ষিত খবরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব, ব্যতিক্রমকে আমরা কতটা উপেক্ষা করছি? কীভাবে চেপে রাখছি বাহ্যিক অশান্তি ও রাজনৈতিক ঠেলাঠেলির অন্তরালে। আমাদের এই মুখ আর দুষ্পাঠ্য অভিমুখ যে কী সর্বনাশ ডেকে আনছে, তার বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই—কেননা ইশারাই যথেষ্ট, আল্ আকিলু তাকফি হু ফিল ইশারাত। খবর এক, বঙ্গভূমি জুড়ে, ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে শুরু হল যুব উত্সব। সকাল থেকে কলকাতায়, ছোটোবড়ো অন্যান্য শহরে বীরযোদ্ধার স্মরণে ছড়িয়ে পড়ল উচ্ছ্বাস। রবীন্দ্র আর নজরুল সঙ্গীতে গলা মেলাল উদ্যোক্তা ও পথচারীদের স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ। মোড়ে মোড়ে ভিড় আর নেতাজির প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি। খবর দুই, এদিনই কলকাতায় ত্রিপুরার পর্যটন মন্ত্রী রতন ভৌমিক জানালেন, ভারত-বাংলাদেশের আখাউড়া সীমান্তকে সাজিয়ে তুলছে তাদের সরকার। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে গড়বে গ্যালারি। ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে পর্যটকদের সামনে ভেসে উঠবে বাংলাদেশের আত্মত্যাগের কাহিনি এবং তার পাশে কীভাবে দাঁড়িয়েছিলেন সাধারণ মানুষ, পাক বাহিনীর ঘন ঘন গুলিবর্ষণে ত্রিপুরাবাসী শহীদের সংখ্যা কী-এরকম বহুতথ্য সংগ্রহশালায় সাজানো থাকবে। খবর তিন, ওই ২৩ জানুয়ারির সকালে আর দুটি মহত্, প্রবল প্রাণবন্ত খবরের সাক্ষী হয়ে রইল কলকাতা। গড়িয়াহাট লাগোয়া মনোহরপুকুর অঞ্চলে তিনটি রাস্তায় বসে, তিন দলে ভাগ হয়ে ছবি আঁকলো সমাজের সব স্তরের চার হাজার শিশু। এ এক অপূর্ব, বিরল দৃশ্য। যানহীন গোটা এলাকা। ঠেলাঠেলি নেই, হইচই নেই। স্নিগ্ধ সকাল। শান্ত দুপুর। আত্মমগ্ন হয়ে পেনসিল দিয়ে, ব্রাশে জল রং ছড়িয়ে, কাগজে প্যাস্টেল ঘষতে ঘষতে নিসর্গের, জীবজন্তুর, ঘরবাড়ির চিত্র নির্মাণ করছে খুদে পড়ুয়ারা—অঙ্কন চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন অভিভাবকরা। উদ্যোক্তা ত্রিধারা উত্সবের সদস্যরা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ তদারকিতে ব্যস্ত। কেউ শৃঙ্খলা রক্ষার কাজকর্মে। এরকম প্রায় সংহত, সংযত, গঠনমুখী প্রয়াসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, হেঁটে হেঁটে দেখছি, আমার দেখার আর হাঁটাহাঁটির সঙ্গী দুজন স্বেচ্ছাসেবী, এঁদের প্রচারবিমুখ তত্পরতা বারবার আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শিশুদের সৃষ্টিসুখের নিঃশব্দ উল্লাসের সঙ্গী হয়ে ভিতরে গুমরে উঠছে আনন্দের রুদ্ধ কান্না—এরকম রাস্তায় বসে হাজার হাজার শিশুর ছবি আঁকার মুহূর্ত কখনও দেখিনি। ৬৯ বছরের একটি ক্লাব যে আলোকবন্ধনে প্রতিটি মরশুমে, প্রতিটি উত্সবে সমাজে সৃষ্টি আর সংস্কৃতি নির্মাণের বার্তা ছড়াচ্ছে, এরকম সদর্থক প্রয়াস কেন জানার চেষ্টা করিনি—একথা ভাবতে ভাবতে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসছে। দুই স্বেচ্ছাসেবীর সহযোগিতায়, তাঁদের কাজের বিস্তার—সমাজসেবা, চিকিত্সা পরিষেবা, বৃক্ষরোপণ, দরিদ্র, উপেক্ষিত মেধাবী ছাত্রদের অর্থসাহায্য, বিভিন্ন উত্সবের প্রাক্কালে গরিবকে বস্ত্রদান, প্রতিবছর স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনকে ঘিরে বহুমাত্রিক ত্রিধারা সমারোহের সূচনা খবর জানতে পারছি, হয়ে উঠছি আবেগতাড়িত, আশপাশে সিগারেটের স্টল নেই, তিন রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলির দরজা জানালা বন্ধ, সামনে জনস্রোত। পরমদয়ালু, হয়তো আমার মতোই ধূম্রপানে আসক্ত একজনের সহমর্মিতায় একশলা হাতে পেয়ে মনে হল, চিন্তার জট খুলবে। জানার সুযোগ ঘটবে, কারা এই বসে আঁকো বিশাল কর্মকাণ্ডের সর্বাত্মক সংগঠক।

দেবাশিস কুমারকে বিভিন্ন সভাসমিতিতে দেখেছি। সুপরিচিত মুখ। আলাপ ছিল না, বাংলা খাবারের সফলতম সংস্থা ভজহরি মান্নার সৃজনশীল কারিগর রাজীব নিয়োগীর মারফতে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। তিনি যে বনেদি পরিবারের সন্তান, বইপ্রেমী, বাংলা গদ্য-পদ্যের সঙ্গে নিয়মিত তাঁর সহবাস, সদর্থক রাজনীতির প্রবক্তা— এসব তথ্য একটু আধটু জানা ছিল। গত সপ্তাহে আমাদের সরাসরি দ্বিতীয় সাক্ষাত্। চিত্র সজ্জিত কবিতার বই ‘সম্রাট’ তাঁকে দিতে গেছি। হাতে পেয়ে, মলাটে কিঞ্চিত পরিচিত আঁকিয়ের নাম দেখে বললেন, ২৩ জানুয়ারি আমাদের এখানে, মনোহর পুকুরে হাজার শিশু রাস্তায় বসে ছবি আঁকবে। সম্ভব হলে একটু আসবেন। শুনেই বিম্মিত! এত খুদে, নির্মীয়মাণ চিত্রীদের মেলা! বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। ফিরে সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে অফিসকে জানিয়ে দিই, অন্য কেউ নয় আমি নিজেই যাব। অতএব, যেতেই হল। আর ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে শৃঙ্খলা আর শিশুদের একাগ্রতার যৌথ বিন্যাস দেখে প্রায় বাক্যহারা। এর কারণ চারটি। প্রথমত, দেবাশিস, লালটু মুখার্জির মতো জনাকয়েক সংগঠকের ঢাকঢোলহীন প্রয়াসের পরিধি যে কতটা বিস্তৃত, কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন, উত্সাহব্যঞ্জক, তা না দেখলে আমার নিজের সাংগঠনিক অক্ষমতা যাচাই করার ইচ্ছে আত্মতুষ্টিতে সীমাবদ্ধ থেকে যেত। দ্বিতীয়ত, কখনো কখনো ব্যক্তিশ্রম কী রকম বৃহত্তরকে স্পর্শ করে বিশেষকে ছাড়িয়ে নির্বিশেষের নির্মোহ অংশ হয়ে ওঠে, এই সত্যকেও অনুভব করার সুযোগ ঘটত না। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সত্তা যখন নির্বাচকদের দরদী প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চায়, তখন সে আত্মস্বার্থকে প্রশ্রয় দেয় না। হতে চায় সেবা ও সুবিচারের প্রবক্তা। সংস্কৃতি প্রেমও তাঁর ওপর ভর করে। এছাড়া, গণমাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে জেগে উঠল আমার প্রশ্ন—আমরা কি কেবল রাজনৈতিক ঠেলাঠেলি, কটাক্ষ ও হিংসাকে গুরুত্ব দেব, এসবেরই খবর করব? দেবাশিসের মতো জনপ্রতিনিধি (মেয়র পারিষদ, কলকাতা পুরসভা) ও তাঁর সহযোগীদের কর্মকাণ্ড তথাকথিত চমক জাগানো সংবাদের আড়ালে চেপে রাখব? ২৩ জানুয়ারি—কলকাতা, কলকাতার বাইরে দিল্লিতে খবর হবার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে। এই যেমন, সল্টলেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও উপমহাদেশের অন্যতম সেরা চিকিত্সক সুকুমার মুখোপাধ্যায় প্রতি সবিনয় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল আজকাল পত্রিকা। দুজনের হাতে স্মারক তুলে দিলেন ভারতের সফলতম শিক্ষা সংগঠক সত্যম রায় চৌধুরী। শহর থেকে ৩০ মিনিট দূরত্বে তরুণ সমাজসেবী কাইজার আহমেদের উদ্যোগে নেতাজি উত্সবে মেতে উঠল ভাঙড় ও ঘটকপুকুর এলাকা, কলকাতার পূর্বপ্রান্তের গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে অঙ্কনে, নৃত্যে মেতে উঠল এক হাজার বহুবর্গীয় পড়ুয়া। এসব খবর-আখাউড়া সীমান্তকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি দিয়ে সাজানোর সংবাদটিও অবহেলার স্তরে পড়ে থাকল। কেন খবরের ভেতরের সত্যকে গুরুত্ব দিই না, কেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রশস্ত বসে আঁকো প্রতিযোগিতা (মনোহরপুকুরের) সংবাদটিকে দিনের সেরা, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খবরের মূল্য দিতে পারি না, এই ব্যর্থতার কারণ কী? পেশাদারিত্বে স্বচ্ছতা আর উদারতার অভাব না ক্ষীণ দৃষ্টি। নেতাজির জন্মদিন থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এরকম আরো বহু সংবাদও দৃষ্টির আড়ালে পড়ে রইল। উদাহরণ, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মাঞ্চল দেউলটিতে জনচিত্তজয়ী লেখককে ঘিরে ৭ দিনের উত্সব, পর্যটন মেলায় বাংলাদেশের প্রাণচাঞ্চল্য, ৪০তম কলকাতা বইমেলায় উদ্বোধনী ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আবেগ জড়িত স্বীকৃতি—বিশ্ব এসে মিলে যায় বাংলায়। বাংলাদেশের বই-এর জন্য পশ্চিমবঙ্গের আগ্রহ বাড়ছে, ঢাকার প্রকাশকরা দল বেঁধে মেলায় আসছেন। এসব খবর কি এতই গৌণ? গুরুত্বহীন? বড়ো খবরের মতো মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়? সাবলটার্ন ইতিহাস এই ধরনের সংবাদকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কারণ এখানে এই পরিসরে সে খুঁজে পায় সত্য আর ভবিষ্যতের পরিক্রমা।