ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব ও বাংলাদেশ

প্রতিটি দেশেরই রয়েছে সম্ভাবনা, তবে সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব। সকল ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব একটি দেশের উন্নয়নে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সঠিক নেতৃত্ব একটি দেশের শ্রেষ্ঠ চালিকা শক্তি ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এর দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে অনেক আছে। যেমন, গত দু’দশকে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন সফলতার শীর্ষে। এর কারণ একটাই, সঠিক নেতৃত্ব। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের অভাবটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। এ কারণে আমাদের দেশ ক্রমশ পরিণত হয়েছে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই দেখা যায়, দুর্নীতি ও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা। ফলে সম্পদ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত হতে পারেনি আমাদের দেশ।

এই নেতৃত্ব তৈরির জন্য বিভিন্ন সংগঠন নিয়মিত আয়োজন করে যাচ্ছে ‘ইয়থ লিডারশীপ’ শিরোনামে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম। কিন্তু এর বাস্তবতা দৃশ্যমান যেন অমাবস্যার চাঁদের রূপ লাভ করেছে। বার বার প্রমাণিত হচ্ছে, পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে নেতৃত্ব তৈরি সম্ভব নয়, নেতৃত্ব হলো চর্চার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব তৈরির জায়গা দুটি। ছাত্র সংসদ ও ছাত্র রাজনীতি।

বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা শুরুর জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতা নির্বাচন শুরু করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তা আজ উপেক্ষিত। নির্দিষ্ট সময় শেষে একটি সনদপত্র প্রাপ্তিই উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয়। উচ্চশিক্ষা পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন আরো কিছু অনুষঙ্গের। যা একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মানবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুণের বিকাশ ঘটায়। এ গুণগুলোর অধিকাংশ পূরণ করে থাকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। এটাকে বলা হয় নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। এখান থেকে শুরু হয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা। এটি একটি অরাজনৈতিক ব্যানার। এখান থেকে শ্লোগান উঠবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের, মিথ্যাকে দূরীভূত করার ও সত্য প্রতিষ্ঠিত করার। সর্বোপরি, সমৃদ্ধ দেশ গড়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত করা হচ্ছে এই মৌলিক অধিকার থেকে। এর জন্য কারণ হিসেবে আঙুল তোলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দুর্নীতি ও অনিয়মের দিকে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালু থাকলেও বন্ধ রয়েছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বন্ধ রয়েছে প্রায় ২৩ বছর। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চকসু) ২২ বছর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ২৪ বছর ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ২৪ বছর নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। অর্থাত্ সবগুলো বর্তমানে অকার্যকর। এরশাদের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে বন্ধ রয়েছে এই নির্বাচন। ফলে বিকশিত হতে পারছে না সুপ্ত নেতৃত্ব।

নেতৃত্ব তৈরির অন্য ক্ষেত্র— ছাত্র রাজনীতি। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও আজকে যেন তারা ছিটকে পড়ছে তাদের আদর্শের বা বৈশিষ্ট্যের কক্ষপথ থেকে। স্বাধীনতার পর ছাত্র সংগঠনের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না যোগ্য নেতৃত্ব। বরং বাড়ছে কোন্দল, হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য ও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা। আরো বাড়ছে ইভটিজিং, মাদক ও অস্ত্রের ঝনঝনানি।

এদের অপকর্মের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে মূল দল ও স্থানীয় প্রশাসন। এরা পদের জন্য নিজ দলের কর্মীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না।

এদের কাছে দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ফোর্বস সাময়িকীতে উল্লিখিত ১০টি নেতৃত্বের ন্যূনতম গুণাবলি। ফোর্বস সাময়িকীর মতে নেতৃত্বের দশটি গুণাবলী হলো— ১. Honest, ২. Delegate, ৩. Communication, ৪. Confidence, ৫. Commitment, ৬. Positive latitude, ৭. Creativity, ৮. Intuition, ৯. Inspire এবং ১০. Approach.

এদের নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কর্মের চেয়ে জন্মকে। আজ প্রতিযোগিতাকে বাদ দিয়ে বেছে নেওয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে। এরা কলমের পরিবর্তে হাতে নিয়েছে অস্ত্রকে। তাই আজ মশাল যাচ্ছে অন্ধের হাতে। ফলে সে পথ না দেখিয়ে আগুন দিচ্ছে মানুষের ঘর-বাড়িতে, নিজের অজান্তে। আর সাধারণ ছাত্রসমাজ আজ ঘৃণা করছে ছাত্র রাজনীতিকে।

সুশৃংখল ছাত্র-রাজনীতি ও ছাত্র-সংসদ নির্বাচন-চর্চা আর পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারলেই বাংলাদেশেও জন্ম নেবে আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, মাহাথির মোহাম্মদ, নেলসন ম্যান্ডেলা ও লি কুয়ান ইউর মতো নেতৃবৃন্দ। আর দেশ এগিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে।