সুদহার কমানোর পরও বিক্রি বেড়েছে সঞ্চয়পত্রের। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ হয়েছে। এ সময়ে সরকার নিট ১৩ হাজার ৩০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। এ বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার করেই প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই নিট ১৩ হাজার ৩০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে সরকার। যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ পূরণ করেছে। সেই সঙ্গে এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। এই অবস্থায় অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি দ্বিগুণ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বছর শেষে তা ২৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকায় ঠেকে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গেল ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সময়ে পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ২৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৩৫৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ডিসেম্বর মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫৯১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ হাজার ৭৬৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১ হাজার ৯৪৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একক মাস হিসেবে গত ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে একটু বেশি লাভের আশায় সবাই ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সুদের হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে এখনো অন্য যে কোনো স্কিম থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়, সে কারণেই বিক্রি বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের ভার কমাতে গত ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ২ শতাংশ করে কমায় সরকার। তবে ওই সময়ের আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তারা আগের সুদেই মুনাফা পাবেন বলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর জানায়। ২৩ মের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনলে ১৩ দশমিক ৪৫ ও ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যেত। সুদের হার কমানোর পর এখন কেউ পাঁচ বছর মেয়াদি পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। আর পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। ৩ বছর মেয়াদি ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সুদ হার ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে সুদ হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।
এদিকে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ব্যাংকঋণ তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। অর্থাং ব্যাংক থেকে সরকার কম ঋণ নিচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণ কমে এক লাখ ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ছয় মাস আগে গত জুন শেষে যা এক লাখ ৫ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ছিল। এ হিসাবে ছয় মাসে সরকারের নিট ঋণ কমেছে ৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণের মধ্যে ৯৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। বাকি ৮ হাজার ১৭৯ টাকা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যেও অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বর্তমানের মতো ঋণাত্মক ধারায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।