একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীকে উন্নতির শীর্ষ চূড়ায় উঠতে হলে অবশ্যই তাদের মহান নায়কদের মনে রাখতে হবে। অতীতের গৌরবময় আন্দোলন ও বিজয়কে মনে রাখতে হবে। ব্রিটিশরা উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পেরেছে। কারণ তারা লর্ড নেলসন ও ডিউক অব ওয়েলিংটনের মতো নেতাদের গৌরবকে ধরে রাখতে পেরেছে। জাতীয়তাবোধের দৃষ্টান্তে জাপানের নাম সর্বাগ্রে। কারণ জাপানিরা এক মানুষ, এক দেশ, এক সংস্কৃৃতিতে বিশ্বাসী একটি জাতি। এপিজে আবদুল কালামের একটি লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য মনে পড়ে গেল। বেবী মওদুদ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর আলোচনায় বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ ছাড়া কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে জনগণের অনুভূতির ওপর। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই মরণ-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
বাঙালির সব অর্জনে জাতীয়তাবাদ বোধ কিংবা চেতনা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তির সনদ ৬ দফায় এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ইতিহাস আমাদের গৌরবান্বিত করে। জাতীয় স্বার্থে এক হয়ে, উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে দৃঢ় করে তুলবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের দ্বিতীয় মেয়াদের পূর্তি উপলক্ষে এবং বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে সবাই মিলে দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে আরো গুরুত্ববহ করে তুলেছে। ২০১৫ সালটি দেশের মানুষের জন্য একটি স্বর্ণকাল। ওই বছরের অনেক অর্জন আমাদের জাতি হিসেবে শুধু সমৃদ্ধই করেনি একই সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের মধ্য দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও কাজ করছে ঐতিহ্যগত গৌরবকে ধরে রাখার। যে বাংলাদেশ এক সময় মঙ্গা, দারিদ্র্য, দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়ের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল আজ সেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। যে বাংলাদেশে লোডশেডিং ছিল প্রতিদিনকার সঙ্গী সেই বাংলাদেশ আজ ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষকে ইতোমধ্যেই বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছে সরকার। যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করা হয়েছিল আজ সেই বাংলাদেশের কৃষকরা ৩ কোটি ৮৪ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছেন। গত ৭ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ ৫১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করেছে। অবকাঠামো উন্নয়নসহ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে বর্তমান সরকার। তার মধ্যে ১৬টির কাজ ২০১৫ সালে শুরু হয়ে গেছে। বিগত ৭ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃত্তি-উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে বই বিতরণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবারো এক দিনে প্রায় ৫ কোটির কাছাকাছি শিক্ষার্থীর হাতে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭২২টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ বছরেরও বেশি।
এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে দেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের জন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী দেশ সুইজারল্যান্ডের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নি¤œ মধ্যমে আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য সব প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ জাতীয় চার নেতাকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কিত অধ্যায়ের দায়মুক্তির নিরন্তর চেষ্টার সুফল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কলঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে এই সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালকরা শুধু উন্নয়নের মাপকাঠিতে নয় বরং তার ইতিহাসের গৌরবকে ধরে রাখার জন্য, ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় মোচনের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা গৌরবান্বিত এক বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্ব পেয়েছি। জাতি হিসেবে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নেয়ার শক্তি-বিশ্বাস স্থাপন করে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত। ১৯৭১ সালে বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা বীরের জাতি। নিরস্ত্র জাতি হয়েও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর আরোপিত যুদ্ধে জীবন দিয়ে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছিলাম এই জাতি কখনো মাথা নিচু করে না। ৬৮ বছরের ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমানার বিষয়ে স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধান করা এও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের মধ্যকার সুসম্পর্কের কারণে ৫২ হাজার মানুষের মানবেতর জীবনের অবসান ঘটল। আমরা দেখিয়ে দিতে পেরেছি, বাংলাদেশের টগবগে যুবকরা বিশ্বকাপ ক্রিকেট শক্তিধর দলকে কীভাবে পরাজিত করতে পারে। জাতিগতভাবে মানসিক মনোবল কতটা দৃঢ় হলে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প কাজ শুরু করতে পারে তাও দেখিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। সব কিছু ছাপিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের গত ২ বছরের ব্যাপক উন্নয়নকে মাথায় রেখে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ব্ল–মবার্গ বিশ্বের ৯৩টি দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলছে, ২০১৬ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ নতুন নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। এই উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির উন্নয়ন নয় বরং জাতি হিসেবে বাঙালির সব আন্দোলন, সব বিজয়, সংস্কৃতি ও গৌরবের সঙ্গে সম্পর্কিত নিরন্তর ভালোবাসার জাতীয়তাবাদের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তুলে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদার আসনটি আরো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করে তুলি।