রাজশাহীর পবা উপজেলার এসি (ল্যান্ড) শাহাদাতের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে একটি দৈনিকে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন সুশাসনের প্রতিফলন। ভূমির সঙ্গে আমাদের অবিচ্ছিন্ন বন্ধন এবং ভূমিই জীবন-জীবিকা, আবাসন ও অন্তিম জীবনের অবলম্বন। একখণ্ড ভূমি পেতে আমাদের যত আকাঙ্ক্ষা, ওই ভূমিটুকু রক্ষার দুর্ভোগটুকু যেন মৃত্যুযন্ত্রণা। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাঞ্জাব প্রদেশে তাঁর ভূমিকর পরিশোধ করতে খামে করে নায়েবকে (তহশিলদার) ‘ঘুষ’ পাঠিয়েছিলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই দৃশ্যপট তিক্ত হলেও নিষ্ঠুর সত্য। ঔপনিবেশিক আমলের রেকর্ডপত্র, সীমিত জনসম্পদ, ভূমি আইন নিয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং শক্তিমানদের অবজ্ঞা ভূমি প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ। অজস্র নথিপত্রে বন্দি ভূমি অফিসে বসা বা হাঁটার জায়গা নেই, মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কীটপতঙ্গে আক্রান্ত এবং ধুলাবালিতে জরাজীর্ণ জংধরা ট্রাংক থেকে রেকর্ডপত্র নিয়ে ভূমি মালিকরা উপস্থিত হন এসি (ল্যান্ড)-এর কাছে। নথি পরীক্ষা করে, আইনকানুন ঘেঁটে, শুনানি গ্রহণ করে, মাঠ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নির্মোহ দৃষ্টিতে আদেশ প্রদান করতে হয়, যা বিচারিক কার্যক্রমের সমতুল্য। এর মধ্যে জাল দলিলের চোরাবালি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হয়। ২০০৮ সাল থেকে আড়াই বছর বগুড়ার এডিসি (রাজস্ব) পদে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি ভূমি নিয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা, বিষণ্নতা। সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছি আপাদমস্তক সৎ ও সাহসী হওয়ার এবং মানুষের অসহায়ত্ব ভাগ করে নেওয়ার। চুনারুঘাট, দাগনভূঞাা, ফরিদগঞ্জ ও বান্দরবানের মতো প্রান্তিক জনপদে ১৯৯৪ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত অজস্র কাঁটাবিছানো পথে এসি (ল্যান্ড)-এর দায়িত্ব পালন করেছি। প্রত্যন্ত এলাকার ভূমি অফিস আকস্মিক পরিদর্শন, ভুক্তভোগীদের কষ্ট অনুধাবন ও খাসজমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোটরসাইকেলে চষে বেড়িয়েছি মাইলের পর মাইল ইটবিছানো পথ। রোদে পুড়ে ধুলাভরা দীর্ঘ পথে হেঁটেছি। টিনশেড অফিস, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, বিদ্যুৎ নেই, চারপাশে ভুতুড়ে পরিবেশ, তার পরও ঘাম ঝরিয়ে কর্তব্য পালন করেছি।
পুলিশি সহায়তা ছাড়াই বিপত্সংকুল এক অভিযানে ডাকাতিয়া নদীর ১১১ একর অংশ উদ্ধারে সফল হয়েছি। ফেনীতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা অভিযোগের পাহাড়, সে এক মহাকাব্য। সীমাহীন মানসিক চাপ ও নিদ্রাহীন রাত, কিন্তু কখনো আসেনি আতঙ্ক বা অবসাদ। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থেকেও দৃঢ় মনোবল দিয়ে অন্যায় শক্তিকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিলাম। বগুড়া প্রশাসনে জুনিয়র সহকর্মী সুফিয়া নাজিম, সাদিয়া আরফিন, খালেদ হোসেন, নাহিদা হাবিবার সততা, শ্রম ও নিষ্ঠায় ২০০৮ সালে সফল করেছিলাম দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন ক্লিন বগুড়া’। এতে বগুড়ার রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হয়ে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছিল। ভূমি হুকুমদখলের ক্ষতিপূরণের ৩২ কোটি টাকা দুর্নীতিমু্ক্তভাবে ভূমি মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। নামজারিতে দুর্নীতি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসায় রেকর্ডসংখ্যক (প্রায় ৫৫ হাজার) নামজারি নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছিল। এর পশ্চাতে প্রশাসনের সততা, জনগণের সচেতনতা ছিল বড় শক্তি। বগুড়ার এসি (ল্যান্ড) নাসরিন আকতার ও চট্টগ্রামের এসি (ল্যান্ড) সামিউল মাসুদের উদ্যমী চেতনায় নথি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন এবং নামজারি প্রক্রিয়া ডিজিটাইজ করা হয়েছে। এভাবে শাহাদাতের মতো অন্যদের অবদান বাদ দিয়ে সাফল্যের ইতিহাস হবে অসম্পূর্ণ। ভোগবাদিতার তাড়নায় এখন মানুষের জমি কেনার তৃষ্ণা বেড়েছে। তা ছাড়া বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতায় ও পারিবারিক স্বার্থপরতায় ঘটছে ভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজন, যার ফলাফল বার্ষিক ২০ লাখ নামজারি বা মিউটেশন। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ ৯৮৪ বর্গমিটার। সঠিক নামজারির জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকভাবে সব হস্তান্তর দলিল এসি (ল্যান্ড)-এর সামনে উপস্থাপন। এর ব্যতিক্রম হলে নামজারি হবে না। একটি খতিয়ান সমগ্র নামজারি প্রক্রিয়ার নির্যাস, যা ভূমি মালিকানার রক্ষাকবচ। নামজারির আদেশ নির্ভুল না হলে এসি (ল্যান্ড)-এর দক্ষতা-সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যার অনিবার্য পরিণতি মামলা এবং সামাজিক অস্থিরতা। দেশের ৬০ শতাংশ মামলা ভূমিকেন্দ্রিক, যার সংখ্যা বর্তমানে ১৮ লাখ। এসি (ল্যান্ড) অফিসের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন রেজিস্ট্রেশন অফিস ও সেটলমেন্ট অফিসের সেতুবন্ধ। ভূমি অফিস যত দ্রুত ইন্টারনেট, সিসিটিভি ও মোবাইলের নিয়ন্ত্রণে আসবে, তত দ্রুত অনিয়মের ভূত পালাবে। প্রতিটি আবেদন অনলাইনে এনে তিন থেকে সর্্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির সফটওয়্যার উদ্ভাবন করতে হবে। নামজারির পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউনিয়ন থেকে জেলা অফিস পর্যন্ত নতুন মালিকের নামে রেকর্ড সংশোধন নিশ্চিত করতে হবে, নির্ধারিত ফির বিনিময়ে খতিয়ানের প্রিন্ট সরবরাহ করতে হবে এবং অনলাইনে তা দিতে হবে। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভূমি অফিসের টাউট-দালাল উচ্ছেদ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে মৃত্যু ছাড়া সবই অনিশ্চিত। সুতরাং আজকের কাজ এবং আজকের নথি আজকেই শেষ করে যেতে হবে, কাল সে সুযোগ হারিয়ে যাবে। ভূমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পেশাদারি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন উচ্চমানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং ল্যান্ড ভার্সিটি স্থাপন। ভূমি প্রশাসনে ৯টা-৫টা গতানুগতিক সময়সূচি মেনে কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, এখানে প্রয়োজন ১০-১২ ঘণ্টা শ্রমের গভীর নিষ্ঠা। কঠোর নিয়মনীতির অনুশাসনে পাল্টে দিতে হবে অনিয়ম-দুর্নীতির সমীকরণ। ভূমি প্রশাসনের দুর্নামকে শতভাগ সুনামে রূপান্তর করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। মানুষ প্রশাসনকে ততটুকু সম্মান দেয়, যতটুকু মানুষকে সম্মান দেওয়া হয়। শুধু মেধা বা প্রতিভার গৌরব নয়, মানুষের কষ্ট মুছে দেওয়াই প্রশাসনের সার্থকতা। সহজ-সরল মানুষ এবং শান্ত-সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজন ঘটিয়ে এসি (ল্যান্ড)-রা দেশপ্রেমিক ও পরিবেশবিদ হবেন—নতুন বছরে এই প্রত্যাশা থাকল।
লেখক : সাবেক এসি (ল্যান্ড) ও এডিসি (রাজস্ব)
বর্তমানে সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লি.