দীর্ঘ টানাপড়েনের এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংককে ‘না’ বলার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু আরও কয়েক বছর স্বপ্নই থেকে যাবে। কিছুদিন পর সবাই দেখলেন, পদ্মাপাড়ে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। আর গত মাসে শুরু হয়েছে মূল নির্মাণকাজ। বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তিতে সাফল্যের কথা বলতে গেলে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো পদ্মা সেতুর কথাই বলবেন। নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় কাজ শুরুর দৃঢ়তাকে এখন বিশ্বব্যাংকই প্রশংসা করছে। অবকাঠামোর বাইরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে গত দুই বছরে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ গত বছর নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা কিংবা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ঢাকার তীব্র যানজটের কারণে কারও অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যখন পণ্ড হয়ে যায়, তখন তিনি জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারেন না। উদ্যোক্তারা যখন গ্যাসের সংযোগ পান না, তখন বিনিয়োগ নিয়ে দুশ্চিš-া চলে আসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের ধীরগতি ভাবিয়ে তোলে তাদের। গত দু’বছরে এসব বিষয়ে দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি।
শুধু সরকারকে দোষ দিলে হবে না। অবশ্য ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রথম দুই-তিন মাস বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ডাকা হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতার কারণে সরকারের অনেক পরিকল্পনা ঠিক মতো এগোয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, রফতানি ব্যাপকভাবে বাধাগ্র¯- হয়। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে আ¯’া হারায়। এর খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন।
সরকারের দুই বছর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সমকালকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের বোকামিসুলভ হুমকি-ধমকি পাত্তা না দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করা বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য। এছাড়া অব্যাহতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে সরকার। তবে অবকাঠামোর আরেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পে
দীর্ঘসূত্রতা এবং রেলের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়াকে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করেন তিনি।
ফরাসউদ্দিন বলেন, মানব উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রশংসাযোগ্য। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে শিক্ষা ও স্বা¯ে’্য ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে নিম্ন-মধ্যম ক্যাটাগরিতে উঠেছে। পাকি¯-ান এখনও নিম্ন পর্যায়ে রয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় পঞ্চম।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বা¯-বায়ন বিশেষভাবে নজরদারি শুরু করে। ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ নামে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এসব প্রকল্প তদারকি করা হচ্ছে। এর ফলও পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মা সেতুসহ ৮টি প্রকল্প এর আওতায়। অন্য প্রকল্পের মধ্যে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ সরকারের বর্তমান মেয়াদে শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে সামনে রেখে এর অবকাঠামো উন্নয়নে একটি প্রকল্প বা¯-বায়ন চলছে। ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্পের বাইরে আরও কয়েকটি বড় প্রকল্প বা¯-বায়ন চলছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার, মাতারবাড়িতে জাইকার সহায়তায় কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প বা¯-বায়নে দেরি হলেও এখন পুরোদমে কাজ চলছে। এ প্রকল্প খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে। তবে সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা¯-বায়নে ধীরগতি কাটাতে পারেনি বর্তমান সরকার।
বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি: অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগ বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে। গত দু’বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ গত ৪ বছর ধরে জিডিপির ২২ শতাংশে ¯ি’র হয়ে আছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কার্যকরভাবে এগোয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সময়ে বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের দুশ্চিš-ার কথা জানিয়েছেন।
সরকারের এই মেয়াদে রফতানি ও রেমিট্যান্সেও ধীরগতি ছিল। গত অর্থবছরে রফতানি বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩ শতাংশ। রেমিট্যান্স বেড়েছিল প্রায় ৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চাহিদা বেগবান না হওয়া এবং রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি-পরবর্তী নানা প্রতিক্রিয়া রফতানি খাতে প্রভাব ফেলেছে। তবে পোশাক খাতে এখন যে সংস্কার চলছে, তার সুফল আগামীতে পাওয়া যাবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ। রফতানি সাম্প্রতিক সময়ে একটু চাঙ্গাও হয়েছে। তবে রেমিট্যান্স পরি¯ি’তি এখনও নাজুক।
বিশ্ববব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের মতে, বিনিয়োগ যে একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়। তবে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে বিনিয়োগ দরকার, তাতে খুব একটা অগ্রগতি হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্গ্নোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্টে বাংলাদেশের অব¯’ার তেমন উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিযোগী কিছু দেশ ভালোই এগিয়েছে। অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ম-কানুনসহ নানা ক্ষেত্রে কিছু সংকট রয়েছে।
উদ্যোক্তাদের মতে, অনেকের নতুন বিনিয়োগের সব প্র¯-ুতি আছে অথচ গ্যাস সংযোগ পাচ্ছেন না। বড় কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঠিকমতো গ্যাস দিতে পারছে না সরকার। গ্যাসচালিত অনেক কারখানা প্রেশারের অভাবে উৎপাদন ক্ষমতার পুরো ব্যবহার করতে পারছে না। সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এলএনজি আমদানি করে সরকার এ সমস্যার সমাধান করতে চায়।
আইএমএফ মনে করে, বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, এখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। জ্বালানি ও পরিবহন খাতে এ সংকট বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যে কঠিন নিয়ম-কানুনের বোঝাও বিনিয়োগের বাধা। মিশনের মতে, ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাব ঋণের সুদহার কমাতে দিচ্ছে না। একই সঙ্গে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্র¯- করছে। গত অক্টোবরে বাংলাদেশকে নিয়ে কান্ট্রি রিপোর্টে আইএমএফ বলেছে, রাজনীতিতে সংঘাত কমে এলেও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তাকেও অনেকে বিনিয়োগে ধীরগতির আরেকটি হিসেবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
নিয়ন্ত্রণে ছিল মূল্যস্ফীতি : বর্তমান সরকারের প্রথম অর্থবছরে (২০১৪-১৫) গড় মূল্যস্ফীতি সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কম হয়। আগের কয়েকটি বছরে ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যš- মূল্যস্ফীতি ছিল। গত অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। গত ডিসেম্বর পর্যš- মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশেই রয়েছে। বাজারে চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে ছিল। আš-র্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও পণ্যমূল্য কম থাকাই এই স্ব¯ি-র বড় কারণ। বেসরকারি সং¯’া ক্যাব বলেছে, তুলনামূলকভাবে ২০১৫ সালে দ্রব্যমূল্য অনেকটা ¯ি’তিশীল ছিল। জীবনযাত্রার ব্যয় আগের বছরের তুলনায় কম বেড়েছে।
নানা সম্ভাবনা: ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ হচ্ছে সকল নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণের দেশ। সত্তরের দশকে পশ্চিমা দুনিয়ার চোখে তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা উন্নয়নে গিনিপিগ ‘টেস্ট কেস’ জাতীয় সকল ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পরীক্ষিত মডেল। প্রবৃদ্ধির দিকে দিয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক পর্যায়ে অন্যতম সেরা দেশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা চীন ও ভারতের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশে গত এক যুগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির উত্থান-পতন ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন নয়, বিশ্বের অনেক উদীয়মান অর্থনীতির চেয়ে কম। এর মানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল খুবই ¯ি’তিশীল।
জাপান বাংলাদেশকে দেখছে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে। চীন অবকাঠামো, জ্বালানি ও বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভারত বাংলাদেশকে দেখছে পারস্পরিক বিনিয়োগ, সংযোগ ¯’াপন, বাণিজ্য ও সম্প্রীতির দিকে থেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হিসেবে। সরকার কয়েকটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে, যা দেশকে বদলে দেবে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অব¯’ান কৌশলগতভাবে সম্ভাবনাময়। বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই অব¯’ান একটি বাড়তি শক্তি। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসায়িক সংযোগের কেন্দ্র¯’ল ভাবা হচ্ছে বাংলাদেশকে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, ভারত এবং শ্রীলংকা বাংলাদেশকে তাদের ব্যবসায়িক সংযোগের ভবিষ্যৎ পথ হিসেবে দেখছে। সিঙ্গাপুরের দ্রুত উন্নতির প্রধান কারণ সংযোগশীলতাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা। আš-র্জাতিক সমুদ্রসীমা বিষয়ক জটিলতার নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতির বড় সম্ভাবনা। বাংলাদেশ এখন জনিমিতিক সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম। ২০৪০ সাল পর্যš- এই অব¯’া থাকবে।