সহনশীলতা আর গ্রহণযোগ্যতার উদার মানসিকতা শীতের কুয়াশার মতন লক্ষ করছি বর্তমানের রাজনীতিতে এ কি অব্যাহত থাকবে যদি থাকে তবেই ভালো। সংসদীয় রাজনীতির দ্বান্দ্বিক পরিবেশ গোটা দেশটাকে ‘জিম্মি’ করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতন সাংগঠনিক শক্তি অন্য কারও নেই। ‘সশস্ত্র বিপ্লব’-এর রাজনীতি যারা করতেন, তারাও ঝুঁকেছেন সংসদের প্রতি, তবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে। আত্মশক্তির যে উত্থান তৈরি হয়েছিল সত্তরের দশকে গত শতাব্দীতে, তবে খেই হারিয়ে ফেলে, দেশীয় রাজনীতিতে একমাত্র বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হতে পারত যারা, তারা আজ কৃষক-শ্রমিকের কথা মুখে বলেন কিন্তু জনগণের আদতশক্তি হিসেবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে না গিয়ে উপরি রাজনীতিতেই ‘গোঁৎ্তা খেয়ে’ পড়ে আছেন। মানুষ কিন্তু বিকল্প চায়। অথচ গোটা দেশটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ৪৪টা বছর কাটিয়ে দিল দেশ আর জনগণের প্রগতির দিকে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে পূর্বপুরুষের ঐশ্বর্যম-িত রাজনৈতিক ধারাকে অনুসরণ করে ঔপনিবেশিক নিপীড়ক শক্তির বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের মাধ্যমে দেশটাকে শত্রুমুক্তির দ্বারপ্রান্তে ১৯৭১ সালে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত শতাব্দীর মহত্তম লড়াইÑ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নানা অপশক্তির কৌশলে নিগৃহীত হতে হয়েছে কত যে বার তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই অপকৌশল জয়ী হয়েছে আমাদের দুর্বলতার কারণে। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সমর্থন করেছিলেন, সশস্ত্র লড়াইয়ে জানকবুল করে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশকে পাকিস্তানি নিপীড়ক দস্যু আর নরপিশাচ হায়েনার দলকে বিতাড়িত করে মাতৃভূমিকে পুনরুদ্ধার করতে। অথচ দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক ফারাক ক্রমে বাড়তে থাকলে মুক্তিফোজ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের বন্ধনও ক্রমে ঢিলে হতে থাকল রাজনৈতিক একদর্শিতার কাছে। অন্যদিকে চক্রান্ত, কুমতলব আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে থাকল এবং স্থানীয় নরপিশাচ শক্তিÑ ঘাতক, দালাল-দোসর-জল্লাদ গোষ্ঠী গোপনে একত্রিত হতে হতে গোপন আস্তানা ছেড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়ার অপরিপক্ব রাজনীতি এবং ক্ষমতালিপ্সার সুযোগ নিয়ে দেশীয় রাজনীতিতেই পাখা মেলে দিল। ক্রমে ক্রমে রাজনীতি হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধীশক্তি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে গিয়ে জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরকে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানি কায়দায় সেনাশাসন জারি করেছিল দেশে। এর বিরুদ্ধে যে জনমত তার সুযোগ গ্রহণ করে জিয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে জেনারেল এরশাদ গদিনসীন হলেন। প্রায় এক দশকে তার স্বৈরশাসন দেশবাসীকে হত্যা, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করে ফেলল। তারপর সবাই মিলে এরশাদকে হটিয়ে একটা আপসরফায় ক্ষমতাবদল হলো।ৃ কত নির্মম ইতিহাস রচিত হলো। তারপর নিরবধি দিনরাত্রির সংগ্রামী আমাদের আবার গণতন্ত্রের পথে পৌঁছে দিল। কিন্তু কী অদ্ভুত! জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিতে গেলেন। অতঃপর যেসব কুৎসিত রাজনীতির নামে যে ঘটনাবলি হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই। আর আমরা তো এই দেশেরই লড়াকু মানুষ, সব অঘটন-অপশাসনকে কখনো কিছুটা সহ্য করে আবার কখনো বিদ্রোহ করে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের মতামত। তাই গণতন্ত্রের যাত্রা যদিও বা শুরু হলো, তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ করেন না এমন একজন গৃহবধূ নির্বাচিত হলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। একনায়কতন্ত্রের অবসান হলো না, গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কা-কারখানা ইতিহাস বিকৃতি, জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসন নয়, শুধু তাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মন্ত্রী সাজিয়ে তাদের গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দিলেন খালেদা। মুক্তিযুদ্ধ না করা এবং সেই মুক্তিযুদ্ধের হন্তারক-নরখাদক জল্লাদের মিতালি দেশটাকে ধর্মান্ধাতার গহ্বরে নিমজ্জিত করতে শুরু করে সর্বত্র জামায়াতিদের অবস্থানকে পোক্ত করে ফেলল বিএনপির কাঁধে চেপে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে অপশাসন, দুঃশাসনে আমরা যেভাবে নিষ্পিষ্ট হয়েছি, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে কালক্ষেপণ এবং চকিত চর্বণ দুটোই হবে। সূচনাতেই পরিবর্তনের যে আভাস-ইঙ্গিতের উল্লেখ করেছি তাকে একটু খুঁজে দেখি, বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল যারা কোনোদিন রাজনীতিতে পা দেন না ক্ষমতারোহণের জন্য, তারা সচেতন জনগণ এবং দেশের সাধারণ মানুষÑ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা। নারী-পুরুষ আবলবৃদ্ধবনিতা, তারা দেশকে নিঃশর্তে ভালবাসেন; তারা সবাই চান দেশে জিয়া বা এরশাদ গণতন্ত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অন্যতম প্রধানস্তম্ভÑ গণতন্ত্র কার্যকর হোক দেশে। অবশ্য বর্তমান ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী ১৪ দলীয় সরকার যে পুরো গণতান্ত্রিকতা প্রাকটিস করছে তা বলা যাবে না।
অতীতকে দূরে ঠেলে রেখে বর্তমানকেই যদি গ্রহণ করি, তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক মানসিকতা’ বোধহয় নিজস্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে ক্রমেই চেতনোদয় ঘটতে শুরু করেছে, বিশেষ করে দেশের বড় দুটি দলÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মুখে আক্রমণাত্মক বুলি কপচালেও এখন মনে হচ্ছে, কথার ধারটা ক্রমেই কমে আসছে। পারস্পরিক উদারতার পরিবেশ তৈরি হতে শুরু হয়েছে। সহনশীলতা আসবে শিগগিরই মনে হচ্ছে। কারণ বিএনপি যে ভুল করেছিল গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তা নিয়ে প্রচুর রাজনৈতিক গোঁয়ার্তুমি করে দেখেছে মহাজোট সরকার এবং বিশেষ করে দলীয় ভিত্তিতে আওয়ামী লীগকে কাবু করা যাচ্ছে না। খালেদা জিয়া কত নাটকীয় রাজনীতি করলেন কিন্তু জমাতে পারলেন না। ৯৩ দিন নিজ-অবরোধ গুলশান কার্যালয়ে আলিশান ব্যবস্থাপনায় ৩০-৪০ সহচর-সহচারী নিয়ে দিনরাত্রি যাপন করলেন। ফায়দা কিছুই হলো না। মাঝখান থেকে ১৬৪ জন নিরীহ-গরিব মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার অপরাধে ভবিষ্যতে অপরাধের সম্মুখীন হতে হবে। খালেদা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতেও চেয়েছিলেন পারেননি। এখনো পর্যন্ত যে সেনাবাহিনীর প্রতি দারুণ বিরাগভাজন ছিলেন বেগমসাহেবাÑ ইদানীং তিনি তাদের তোষামোদি করে কথা বলছেন। আমলাদের আক্রমণ করছেন বটে তবে রয়ে-সয়ে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব রিজভীসহ অনেক নেতাকর্মী কারামুক্তি পাচ্ছেন জামিনে। তারা আবার সংবাদ সম্মেলন করে ‘বামপš’ায় অভ্যস্ত শব্দাবলিতে ক্ষমতাসীনদের বেশ ভালোই আক্রমণ করছেন। আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন তো ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় আটকে থাকলেও জামিনে দিন গুজরান করছেন। তবে খালেদাপুত্র তারেক পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন ব্রিটিশদের করুণায় লন্ডনে। সেখানে বসে যে বেয়াদবি ও ইতিহাস নিয়ে ছেলেখেলা করছিল, অজ্ঞতার হাস্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিল, তাও যেন থেমে গেছে।
নির্বাচন না করার যে খেসারত বিএনপিকে দিতে হয়েছে, একটি সংসদীয় রাজনীতি করা দল হয়েও তা বোঝার মতন ক্ষমতা তাদের ছিল না। দলের অভিজ্ঞ কর্মী-সংগঠকদের তো কোন পাত্তাই নেই, নেতারাও বেগম জিয়ার ওপর দিয়ে কথা বলতে পারেন না বলে একক সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু মনে সর্বস্তরে প্রচ- ক্ষোভ জমেছিল নেতৃত্বের ওপর। জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করায় দলীয় ইমেজ যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছেন, ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ছেড়ে দিচ্ছেন ক্রমেই। যত মামলাই থাকুক না কেন, ইদানীং সেসব মামলা থেকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। মামলার দিন-তারিখ পড়ছে বেশ দূরে দূরে। তাই বিএনপি এখন নিজেদের গুছিয়ে সংগঠনকে ‘শক্তিশালী’ করার চেষ্টা করছে। কারণ ক্ষোভ ও ক্রোধÑ দুটোই তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন শুরু হয়েছে জোট ত্যাগের ঘোষণা। এই জোটে যারা আছে, তাদের সাংগঠনিক শক্তি যাই থাকুক না কেন, সংখ্যা তো বাড়িয়ে দিয়েছিল ২০ হোক আর ১৮-ই হোক, কিছু যায় আসে না কারণ এদের জনসম্পৃক্ততা নেই এবং বৃহদান্ত ধর্মান্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাসী, যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলেছে। তাই এবার যখন পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তখনো মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। ভেবেছিলেন, ছুঁতার তো অভাব নেই, যে কোনো অজুহাত তুলে বিএনপি হয়তো নির্বাচন ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু তা করেনি। এ থেকে তাদের নির্বাচন ফল এতটা মর্মান্তিক! শিক্ষা এভাবেই হচ্ছে। ফলস্বরূপ, তৃণমূলে যখন যাচ্ছেন তখন তারা বোধহয় বুঝতে পারছেন, এভাবে রাজনীতি বা ক্ষমতারোহণ সম্ভব নয়। তাই এবার ঘর পোড়া গরুর মতোন সামনে সিঁদুরে মেঘে ভয় পাচ্ছে। এবার তাই দল গোছানোর কাজ করার কর্মসূচি নিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার, রাজনৈতিক এতবড় দল গত বছর হরতাল, সন্ত্রাস, অবরোধ, রোডমার্চÑ যা কিছুই ডেকে থাকুক, কোনোটাই সফল হয়নি। ২০১৩ থেকে আজ পর্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। ওপর-নিচের যে উপলব্ধি তার মূল্যায়ন এতদিন না করলেও পৌর নির্বাচনের ফলাফলে যত চিৎকারই করুক না কেন, তারা প্রার্থী বাছাইয়ে অনভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক চর্চাবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারই প্রমাণ মিলেছে।ৃ এখন বিএনপি জোট ও দলের মধ্যেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোট বেরিয়ে গেছে বটে, তারা বেরিয়ে তো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল করতে পারবে না। তাছাড়া এরা তো রাজনৈকিত দল নয়, এরা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, নিজেদের সৃষ্ট তরিকার ছত্রচ্ছায়ায় পীর কিংবা ধর্মীয় নেতার অনুসারী। ধর্মের নামে দল করা যাবে না, এটা মক্তিযুদ্ধ চেতনার দাবি। এ দাবি সরকারকে মানতে হবে। সে জন্য বিএনপি নিজেদের গুছিয়ে, পুনর্গঠিত করে, নেতৃত্ব অদল-বদল করে জাতীয়তাবাদী দলকে নতুন ছাঁচে চালতে চেষ্টা করবে সামনে। দলীয় স্থবিরতার প্রকৃষ্ট নমুনা সংসদীয় অন্যতম প্রধান দল বিএনপির ভেতরে ভেতরে চলছে খুরারোগ। গঠনতন্ত্রে তিন বছর অন্তর কাউন্সিলর হওয়ার কথা, দু’বছরে হয়নি। এবার বাধ্য হবে কাউন্সিল করতে। কারণ হরতাল ডেকে নেতাকর্মী কাউকেই রাজপথে তেমন পায়নি, তাই পরিবর্তন আনতেই হবে যদি রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় এবং জামায়াতনির্ভরতাকে বিসর্জন দিতে হবে। লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়ার রাজনৈতিক পরামর্শে দেশে পলিটিক্স চলবে না। ফলে প্রবীণদের প্রতি অনীহা প্রকাশ পাচ্ছে তৃণমূলে। তাই তাকে বাদ না দিয়ে ‘সম্মান’ দেওয়ার চেষ্টা থাকবে তবে নতুন মুখের অধিষ্ঠান হবে বলে অনেকে মনে করছেন। এছাড়া বিএনপিকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। মহাজোট যেভাবে কঠিন হাতে দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল তা অনেকটা ঢিলে হয়েছে। ফলে দম পাবে বিএনপি। একটা নির্বাচন গেল আরেকটা বুঝি মার্চেÑ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এদিকে মহাজোট সরকারের অংশীদার এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েও সব ধরনের কুৎসিত মন্তব্য করছেন সরকার সম্পর্কে এবং পৌর নির্বাচনে নিজদলের যে আসন প্রাপ্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারে সরকারের কর্মপরিকল্পনা যেভাবে প্রণয়ন করেছেন, তাতে তিনি যে কঠিন হয়েছেন, হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন তা সুস্পষ্ট। সেই সঙ্গে তিনি দলকেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্য সব দিক থেকে আটঘাট বেঁধেই কাজ করছেন। পৌর নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কতটা স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্যতা, তা বিচারের সময় এখন আর নেই। বিএনপি তো এবারে গোটা নির্বাচনে অংশ নিয়ে গোহারা হেরেছে। ছাপমারা, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ধমকি-হুমকি যত অভিযোগই মহাজোটের ওপর আরোপ করা হোক না কেন, ক্ষমতা হাসিনার পক্ষেই। সামনের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন মার্চ-এপ্রিলে। এ নির্বাচনও দলীয় প্রতীকেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখানে আবার সত্যিকার জনপ্রিয়তা যাচাই করার আরেকটা সুযোগ পাবে বিএনপি। তাই ভেবেছিলাম, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দল নিজেদের কাউন্সিল করে ভবিষ্যতেও যদি জনগণের কাছে যায়, তখন পরীক্ষা হবে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে, কে জনগণের কাছাকাছি যেতে পেরেছেন বা পারবেন। সরকারি দল তো অনেকটাই ছাড় দিয়েছে এবং ৫ জানুয়ারি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পুলিশ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কাউকেই দেয়নি। আমি মনে করি, পুলিশ গণতান্ত্রিক আচরণ করেছে। বিএনপি আবার এ নিয়ে কোনো নাটক চালবে কিনা কে জানে। তবে দুই দলই নিজেদের অফিসের সামনে সমাবেশ করেছে। তবে আক্রমণের ভাষা তেমন ধারালো ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে প্রশ্ন রাখব, ৪৫ বছর পর যারা শহীদের সংখ্যা, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে প্রশ্ন ওঠান, তাদের সঙ্গে কি কোনো ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করার প্রয়োজন আছে যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের নির্বোধ করার মতন ধৃষ্টতা দেখাতে পারে, তাদের কি এ দেশে কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত ধীরে ধীরে যে ‘কনজিনিয়াল অ্যাটমোসফিয়ার’ তৈরি হয়েছে এবং এখনো আরও হতে হবে, তবেই সরকারকে অনুরোধ জানাব, আপনারা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে লড়াই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিবিধান করছেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু একই ধর্মনিরপেক্ষতা হরণ করার মতন কোনো আচরণ না করার অনুরোধ জানাব। জামায়াত এবং ধর্মীয় নামধারী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেশবাসী তাবৎ জনগণের আশিস গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন, যত আপসই করুন, যতই এরপর সমর্থক পাবেন বলে আশা করছেন, সবকিছু তুচ্ছ করে জনগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন, তবেই সত্যিকার গণতন্ত্র স্থাপন হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার কথা মুখে বুলি কপচিয়ে যতই বছরের পর বছর আস্ফালন করুন, জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা ক্রমেই কমে যাওয়ার দিকে নজর দিন।
বিএনপিকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, জামায়াত থেকে সরে আসুন। মুক্তিযুদ্ধকে যারা অপশক্তি মনে করেন, তারা দলের অভ্যন্তরে, চাপ সৃষ্টি করুন। যেন দল আর কোনো কারণেই ওদের ওপর নির্ভর না করে।
তবেই সরকারকে অনুরোধ করব, দেশের আপসহীন বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং সব পেশাজীবী প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংলাপ করে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত সফল লাখো শহীদের অবদান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে চলুন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামনিস্ট