এ বছর হবে টেলিকম সেবা সহজলভ্য করার এবং গ্রাহকসন্তুষ্টি অর্জনের : তারানা হালিম

লক্ষণীয় পরিবর্তন আসছে টেলিযোগাযোগ শিল্পে

ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে টেলিযোগাযোগশিল্পে। এ বছরেই মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার সঙ্গে এয়ারটেল বাংলাদেশ একীভূত হতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কম্পানি টেলিটকের সেবা উন্নত করতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। সিডিএমএ (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস) প্রযুক্তির একমাত্র অপারেটর সিটিসেলের মালিকানা বদলের বিষয়েও চূড়ান্ত কিছু ঘটতে পারে এ বছর। সিডিএমএর বদলে জিএসএম (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস) এবং থ্রি-জি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে এ অপারেটরের গ্রাহকরা। এসবের ফলে মুঠোফোনের মার্কেট শেয়ারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এ বছরই ফোর-জি তরঙ্গ নিলাম ও সারা দেশকে থ্রি-জি নেটওয়ার্কে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে (এসওএফ) জমা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কোন কাজে লাগানো হবে তা শিগগির নির্ধারণ করা হবে। পরিকল্পনা রয়েছে মোবাইল অপারেটরদের প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার টাওয়ারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হবে তৃতীয় পক্ষকে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি চালু হতে যাচ্ছে বাংলা ডোমেইন (আইডিএন) ডট বাংলা (.বাংলা)। মার্চ-এপ্রিলে নম্বর না বদলে অপারেটর বদলের সুবিধা চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।

বাংলাদেশে অ্যাডমিন প্যানেল চালুর বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে এ বছর। এপ্রিলের মধ্যে আঙুলের ছাপ নিয়ে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে। সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরেও বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রেখে পাল্টে যাচ্ছে অনেক কিছু। ভয়েস কলের পরিমাণ কমছে; বাড়ছে ডাটার পরিমাণ। উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো টু-জি হ্যান্ডসেট উত্পাদন বন্ধ করে দিচ্ছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এ বছরে টেলিকম সেবা সহজলভ্য ও নিরাপদ করতে চান। গ্রাহকসন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দিতে চান তিনি।

টেলিযোগাযোগবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা লার্ন এশিয়ার সিনিয়র ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে অপারেটরদের কাছ থেকে এখনো উন্নত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আবার অনেক প্রত্যাশিত সেবা যথাসময়ে চালু করা যায়নি।

ফোর-জি : প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গত ফেব্রুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ২০১৬ সালে ফোর-জি ও এলটিইর জন্য তরঙ্গ নিলামের ব্যবস্থা করা এবং সরকারের চলতি মেয়াদে এ সেবা চালু করা। এ বিষয়ে তারানা হালিম বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত এ বছরই ফোর-জি চালু করা। তার আগে সারা দেশকে ২.৫-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্কে আনার কাজ শেষ করা হবে। গ্রাহকপর্যায়ে ইন্টারনেট-সংযোগ খরচ আরো কমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

গ্রামীণফোনের সিইও রবি শেঠি বলেন, কারিগরি দিক থেকে বিবেচনা করলে এ বছরই ফোর-জি চালু করা সম্ভব। টেলিযোগাযোগ নীতি ও স্পেকট্রাম সম্পর্কিত কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। এগুলোর সমাধান হওয়া দরকার। স্পেকট্রাম বিষয়ে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা দরকার।

গ্রামীণফোনের মূল অংশীদার টেলিনর গ্রুপের সিইও সিগভে ব্রেক্কে বলেন, সবচেয়ে প্রয়োজন প্রযুক্তিনিরপেক্ষ ব্যবস্থা। এটি হলে অপারেটররাই ঠিক করে নিতে পারবে কখন কোন প্রযুক্তি চালু করবে।

এমএনপি : তারানা হালিম বলেন, ‘আশা করছি, আগামী মার্চ-এপ্রিলে এমএনপি (মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি) চালু করা যাবে। এখন এ সেবার লাইসেন্স নিলাম প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার জন্য কিছু শর্ত নির্ধারণের কাজ করছি। শর্ত ভাঙলে লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখা হচ্ছে। অপারেটরের সঙ্গে এমএনপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সংঘাত যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।’

এসওএফ : বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে (এসওএফ) প্রায় ৮০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। ২০১১ সালে এটি গঠন করা হয়। ওই বছরের শেষ দিকে অর্থ সংগ্রহ শুরু হয়। বার্ষিক আয়ের ১ শতাংশ তহবিলে জমা দেওয়ার বিষয়ে অপারেটরদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, তহবিলে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল টাকা জমা দিলেও সিটিসেল ও টেলিটকের জমার পরিমাণ এখনো শূন্য। ২০১১ সালেই জমা পড়ে ২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পরের বছর জমা হয় ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রতিবছরই অপারেটরদের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তহবিলে টাকার পরিমাণও বাড়ছে। বিটিআরসির প্রস্তাবে সরকার এ তহবিলের অর্থ ব্যবহারের জন্য ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিধিমালা অনুমোদন করে। বিধিমালায় তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য ১১ সদস্যের কমিটি গঠনের উল্লেখ রয়েছে। কমিটির সভাপতি হবেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। দুর্গম এলাকায় যেখানে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি, সেসব স্থানে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এসওএফের অর্থ ব্যবহার করা যাবে। তহবিলের টাকায় দুর্যোগ মোকাবিলা বা ব্যবস্থাপনার জন্য স্যাটেলাইট ফোন কেনার চিন্তাভাবনা চলছে। সামরিক বাহিনী ও এনজিওকর্মীরা এটি ব্যবহার করবেন। টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজেও এ টাকা ব্যয় করা হতে পারে।

তারানা হালিম বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ওয়্যারলেস কানেক্টিভিটি, দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া, সাইবার সিকিউরিটি এবং থ্রিজি সম্প্রসারণের কাজেও এসওএফের টাকা ব্যয় করা হবে।

টাওয়ার ব্যবস্থাপনা : বিটিআরসি গত বছরের প্রথমার্ধে সিদ্ধান্ত নেয়, মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের কাছে দেওয়া হবে। সমঝোতার ভিত্তিতে অপারেটররা একই টাওয়ার ব্যবহার করলে এত টাওয়ারের প্রয়োজন হতো না। বিটিআরসির গাইডলাইন অনুসারে অবকাঠামো বা টাওয়ার ভাগাভাগি করে ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সুযোগ মাত্র ১৫-১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে।

গত এপ্রিলে বিটিআরসির সভায় গাইডলাইন সংশোধন করে নতুন দুটি প্রতিষ্ঠানকে নিলামের মাধ্যমে এসব টাওয়ার পরিচালনা এবং সব অপারেটরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে এ অবকাঠমো ভাগাভাগি করে ব্যবহারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

তারানা হালিম বলেন, টাওয়ার ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও এ বছরই চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ডট বাংলা : ইন্টারনেট অ্যাসাইনড নম্বরস অথরিটির (আইএএনএ) তালিকায় বাংলা ভাষায় দ্বিতীয় ডোমেইন ডট বাংলা। ডট ভারত নামে একটি বাংলা ডোমেইন ওই তালিকায় আগেই স্থান পেয়েছে। আইএএনএর রুট জোন ডাটাবেইসের তথ্য অনুযায়ী ডট বাংলার নিবন্ধনের তারিখ ২০১১ সালের ৩০ মার্চ। সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছে গত ২৪ জুলাই। ডট ভারত নিবন্ধিত হয় ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। চার বছর আগে ডট বাংলা নিবন্ধন পেলেও কার্যকর করতে দেরি হওয়াতে এর অধিকার হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ। ডোমেইনটি কে নিয়ন্ত্রণ করবে? বিটিসিএল না বিটিআরসি—এ প্রশ্নেই কেটে যায় অনেক দিন। গত জুনে এর অধিকার বহাল রাখতে তৎপর হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ডোমেইনটি গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে চালু করার প্রস্তুতি থাকলেও তারানা হালিম চান ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এর যাত্রা শুরু হোক।

রবি-এয়ারটেল একীভূতকরণ : গত আগস্টে রবি ও এয়ারটেল বাংলাদেশের মালিকরা এক হওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। গত ৯ সেপ্টেম্বর তারা যৌথ বিবৃতি দেয়। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী গত নভেম্বর পর্যন্ত রবির গ্রাহক দুই কোটি ৮২ লাখ এবং এয়ারটেলের গ্রাহক এক কোটি তিন লাখের বেশি। এক হওয়ার পর প্রায় চার কোটি গ্রাহক নিয়ে এটি হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর। পাঁচ কোটি ৬৪ লাখ গ্রাহক নিয়ে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। আর তিন কোটি ২৯ লাখ গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলালিংক। নতুন কম্পানিতে রবির ৭৫ শতাংশ আর এয়ারটেলের ২৫ শতাংশ মালিকানা থাকবে।

বিটিআরসি সচিব মো. সরওয়ার আলম বলেন, কিছু বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুমোদনের পর প্রতিষ্ঠান দুটির একীভূত হওয়ার কাজ সম্পন্ন হবে।