জালের মতো ছড়ানো নদীর ওপর ভর করে নৌপথ চালু ছিল একসময়। তখন নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সারা দেশে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। নৌকায় করে যেতে হতো বেশির ভাগ জায়গায়। গ্রামীণ জনপদে পাকা সড়ক তো পরের কথা, সড়কই ছিল না তেমন। মাটির রাস্তা বা আলপথ ধরে নৌঘাটে পৌঁছতে হতো।
নৌ যোগাযোগের পরই ছিল রেল যোগাযোগ। নিরবচ্ছিন্নভাবে কম সময়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার মাধ্যম ছিল রেলগাড়ি। তখনো সড়ক যোগাযোগের সংহত কোনো কাঠামো ছিল না। মহাসড়কগুলো বিচ্ছিন্ন ছিল নদীর কারণে। বছর পনেরো আগেও দূরের কোনো জায়গায় সড়কপথে যেতে একের পর এক ফেরি পার হতে হতো। স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে যোগাযোগব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে সড়কপথে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকায় তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি উড়াল সড়ক। মেট্রো রেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিটের মতো অবকাঠামো প্রকল্পাধীন। বর্তমানে মহাসড়ক আছে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক আছে তিন লাখ ৪৯ হাজার কিলোমিটার।
সার্বিক বিবেচনায় রেল যোগাযোগের অবনতি হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অংশের পরিবর্ধন হয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু অংশের পুনঃপ্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নৌপথ লক্ষণীয় মাত্রায় সংকুচিত হয়েছে, যদিও যান্ত্রিক নৌযানের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ-জালে স্থান করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। ভারত, নেপাল ও ভুটানের গাড়ি চলাচল করবে বাংলাদেশের ছয়টি সড়ক দিয়ে। এর জন্য চলছে প্রস্তুতি। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ এখন নিজের টাকায় নির্মাণ করছে সবচেয়ে বড় সড়ক ও রেল অবকাঠামো পদ্মা বহুমুখী সেতু। ২০১৮ সালে এটির নির্মাণ শেষ হওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রায় সব জেলাই রেল নেটওয়ার্কে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। রেলপথে বা সড়কপথে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার হয়ে যাওয়া যাবে চীনের কুনমিং পর্যন্ত। এই লক্ষ্যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের সড়কমন্ত্রীরা মোটরযান চলাচল-সংক্রান্ত রূপরেখায় স্বাক্ষর করেন। গত ৭-৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচলবিষয়ক খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ছয়টি রুটও চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর নেপাল ছাড়া বাকি তিন দেশের মধ্যে মোটর শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছরই গাড়ি চলাচল শুরু হবে।
নিজের টাকায় পদ্মা সেতু : ব্রিটিশ সরকারের সময়ে নির্মিত সড়ক, সেতু, রেলপথ নিয়ে চলতে হয়েছে অনেক দিন, এখনো সেগুলো প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতার পর বিদেশি ঋণ আর অনুদানের ওপর ভর করে বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়েছে। এখনো সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে হাত পাতার অভ্যাস ছেড়ে নিজের পয়সায় অবকাঠামো নির্মাণ করার সাহস সঞ্চয় করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা জাইকা ঋণ দিতে এসে নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। শেষে তাদের অর্থায়ন ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে সরকার। ২৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু নির্মাণ করা হবে ২০১৮ সালের মধ্যে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ঘটবে। এর অভিঘাতে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে। যমুনা নদীর ওপর ১৯৯৮ সালে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের যোগাযোগ খাতে মাইলফলক হয়ে আছে। যমুনা সেতু দৈর্ঘ্যে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের ১১তম ও দক্ষিণ এশিয়ার ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার যোগাযোগকে সরাসরি ও দ্রুত করে তোলে এই সেতু। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হয়েছে।
রেল যোগাযোগ : পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ-পশ্চিমের সব জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। ঢাকা (কমলাপুর) থেকে সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। আলাদা এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। পুরনো রেল অবকাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
এখন রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে তিন হাজার ৬২৯টি সেতু আছে। এসবের মধ্যে হার্ডিঞ্জ, ভৈরব, শম্ভুগঞ্জ, ব্রহ্মপুত্র, টঙ্গী, তিস্তা সেতু শতবর্ষের পুরনো। রেলওয়ের ৯০ শতাংশ সেতু ১০০ থেকে ১৫০ বছরের পুরনো। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভৈরব সেতুর পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১০ সালে রেলওয়ের উন্নয়নে ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২৩৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ব্যয় হবে দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ও রামু হয়ে ঘুনদুম পর্যন্ত রেলপথ হবে। ১২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে কুলাউড়া-শাহবাজপুর, শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা ও ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথ সংস্কার করা হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের টঙ্গী-ভৈরব ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশ ডাবল ট্র্যাক করা হয়েছে। লাকসাম-আখাউড়া অংশও ডাবল ট্র্যাক হচ্ছে। ডাবল লাইন হবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ অংশেও। আরো কিছু রেলপথ ডাবল লাইনের হবে। নির্মাণ করা হচ্ছে খুলনা-মংলা রেলপথ।
চার লেনের ১৭ মহাসড়ক : মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮৭টি সড়ক সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রথম এক বছরেই ২৬২টি সেতু মেরামত করা হয়। ধীরে ধীরে জাতীয়, আঞ্চলিক, জেলা ও গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়।
পরে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। অনেক মহাসড়ক দুই লেনের হয়েছে। এসব মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। ইতিমধ্যে ১৭টি মহাসড়ককে চার লেন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার কাজ শেষের পথে। আগামী মে মাসে চার লেনের দুটি মহাসড়কই উদ্বোধন করা হবে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংগতি রেখে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কও চার লেনের হবে। শুরু হয়েছে টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেনের কাজ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন করার জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। শুরু হচ্ছে দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কের চার লেনের কাজ।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৭৬ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ এবং ফেরি চালুর জন্য এ মহাপরিকল্পনা।
নৌ যোগাযোগ : নৌপথ সচল করতে ৫৩টি নদীর খননকাজ চলছে। স্বাধীনতার পর একসঙ্গে এত নদী খননের কাজ হয়নি। ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (ডাব্লিউডিবি)।
চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং সব স্থলবন্দরের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি মাথায় রেখে। এ জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরের আনুষঙ্গিক অবকাঠামো এরই মধ্যে উন্নয়ন করা হয়েছে। চালু করা হবে পায়রা সমুদ্রবন্দর।
উড়াল সড়ক : উড়াল সড়ক নির্মাণে যেন বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া রাজধানী ঢাকা অচল হয়ে পড়েছে গাড়িজটে। জনসংখ্যার তুলনায় গাড়ি কম, তবে গাড়ির তুলনায় রাস্তা কম। রাজধানীকে সচল রাখতে উড়াল সড়ক আর মেট্রো রেলের মতো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ২০০৫ সালে প্রথম উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয় মহাখালী লেভেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে। ১০ বছরের ব্যবধানে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, কুড়িল, বিমানবন্দর সড়ক-মিরপুর, বনানী, খিলগাঁও, তেজগাঁও-বিজয় সরণি অংশে উড়াল সড়ক চালু হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ব্যবস্থাপনায় মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতু বিভাগের অধীনে বিমানবন্দর-কুতুবখালী ২৬ কিলোমিটার ‘ঢাকা উড়াল সড়ক’-এর কাজ শুরু হয়েছে। সেতু বিভাগের উদ্যোগেই বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে ‘দ্বিতীয় ঢাকা উড়াল সড়ক’। রাজধানীর শান্তিনগর থেকে মাওয়া পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। রাজধানীর ৭৩টি ইন্টারসেকশনে দিনে গড়ে নষ্ট হচ্ছে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষতি থেকে রেহাই পেতেই উড়াল সড়ক বা সেতু নির্মাণ চলছে। নির্মিত ও নির্মিতব্য উড়াল সড়কের পেছনে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকার যানজট নিরসনে বাস র্যাপিড ট্রানজিট ও মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে এ বছর। মেট্রো রেল স্থাপন করা হবে রাজধানীর উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল স্থাপনে ব্যয় হবে ২২ হাজার কোটি টাকা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হবে। ১৬টি স্টেশন থাকবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে লাগবে ৩৭ মিনিট। ২০১৯ সালে চালু হবে এ ব্যবস্থা।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হবে টানেল। অবকাঠামো নির্মাণের এসব প্রকল্প বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।
যুক্তরাজ্যের নাগরিক জুুলিয়ান ফ্রান্সিস শুরু থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নকাজে যুক্ত আছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ খেতাব পেয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে সড়কপথে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তিনি দেখেছিলেন বিধ্বস্ত একটি দেশের চিত্র। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী, গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেতু ও কালভার্ট, ফেরিগুলো নিমজ্জিত, অনেক জমি পতিত।
৪৪ বছর পর কী পরিবর্তন হয়েছে বলতে গিয়ে তিনি নিজেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, বিশাল ইতিবাচক দিক হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। সড়ক ও সেতু হয়েছে, মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের প্রসার ঘটেছে। তবে রেলপথে বিনিয়োগ উপেক্ষা করা হয়েছে, এটি বড় একটি ভুল।
আগের সরকারগুলো রেলকে উপেক্ষা করলেও ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলওয়েকে নিয়ে মহাজোট সরকার আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করে। রেলের বাজেট বেড়ে পাঁচ গুণ হয়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার যে উন্নয়ন ঘটছে তা উল্লেখযোগ্য। তবে নৌ, সড়ক ও রেল—এই তিন মাধ্যমের সমন্বয় করে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালের মধ্যে ৮ শতাংশে নিতে বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বাড়াতে হবে। আর অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।