স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আদৌ টিকবে কি না, তা নিয়ে স্বাধীনতার পর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের অনেক নামকরা অর্থনীতিবিদ। কেউ কেউ বলেছেন, কোনোমতে ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী টিকে থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হবে না। ১৯৭৬ সালে এমন অভিমত খোলামেলাভাবেই তুলে ধরেন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পারকিনসন তাঁদের ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের বইয়ে । বইটিতে তাঁরা বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যেকোনো দেশই উন্নত হতে পারবে।’ নব্বইয়ের দশক থেকেই তাঁদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করতে থাকে বাংলাদেশ। ৩১ বছর পর আগের বক্তব্য সংশোধন করে ২০০৭ সালে এই দুই অর্থনীতিবিদ স্বীকার করে বলেছেন, ‘গত তিন দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সীমিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
কেবল এই দুই অর্থনীতিবিদই নন, বাংলাদেশের বিপুল উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা এখন বলছে সবাই। ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ শিরোনামের এক নিবন্ধে প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট বলেছে, ‘কী করা যায়, সেটা দেখিয়ে দেওয়ার মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কী করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’ ২০১৫ সালের মধ্য ডিসেম্বরে, বিজয় দিবসের আগমুহূর্তে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলে গেলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি হবেই। মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) ২৯ শতাংশের সমপরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে। এটা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সংকেত। তিনি বলেন, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের এই বিপুল সম্ভাবনার মূলে নেপথ্য শক্তি হিসেবে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। সরকার, রাজনীতি কিংবা বিশ্ব পরিস্থিতির ঝক্কি-ঝামেলা পেছনে ফেলে নিজের ভাগ্য নিজেরাই গড়ছে। চাষাবাদের জমি দিন দিন কমলেও ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মতো বাড়তি ফসল উত্পাদন করছে এ দেশের কৃষকরা। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম, হরতাল-অবরোধ আমলে না নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে এ দেশের শ্রমিক শ্রেণি। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত বিপুল শ্রমশক্তি তাদের শ্রমে ঘামে বিনির্মাণ করছে বিস্ময়কর উত্থানের পটভূমি। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান রেখে প্রবাসে শ্রম বিক্রি করে দেশে উন্নয়নের স্বপ্ন বুনছে কোটিখানেক বাংলাদেশি। সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে ভারতকেও। নানা সময়ে এর প্রশংসা করছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। এই উন্নয়নের জন্য সাধারণ মানুষ সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেনি—সাধারণ মানুষের এই শক্তিকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে ঝুঁকি নিয়ে এ দেশের ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছে শিল্প-কারখানা। এদের ওপর ভর করেই আগামী দিনে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে তারা। এদের সমষ্টিগত শক্তি দুই দশক ধরে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে তুলে রেখেছে। মাত্র দশমিক ৫৭ শতাংশ অস্থিতিশীলতা নিয়েও গত ২০ বছরে বাংলাদেশের মতো শতকরা পৌনে ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব অর্জন ধরে রেখে সামনের দিনে আরো উচ্চতর চূড়ায় পৌঁছানোর হাতছানি রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। তবে এ জন্য দরকার কিছু উদ্যোগ আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে বড় কারণ অবকাঠামোগত সংকট, জমির স্বল্পতা, মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকের অভাব আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশের শিল্প-কারখানায় মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক নিয়োগ পাচ্ছেন ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ব্যক্তিরা, যাঁদের পেছনে বছরে বেতন বাবদ খরচ হচ্ছে ৫০০ কোটি ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে ওই অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব সহজেই। কারখানা স্থাপনের জন্য জমি পেলে, সময়মতো গ্যাস-বিদ্যুৎ পেলে দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা মুহূর্তেই ঝুঁকবেন সেখানে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়নের মাধ্যমে অনিশ্চয়তা দূর করে ব্যবসায়ীদের আস্থা সৃষ্টি করতে পারলে অর্থপাচার বন্ধ হবে, বিনিয়োগ হবে দেশে। এর মধ্য দিয়েই এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে অর্জিত সাফল্যও হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অগ্রগতি একসময় ছিল সিঙ্গাপুরের সমান পর্যায়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশের চেয়েও নিচে নামিয়ে এনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর আবারও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পতিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের প্রথম কয়েক মাস পর্যন্ত দেশে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। জাতীয় নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বিশেষ করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালেই ৫০৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই সময়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হারে জ্বালাও-পোড়াও হয়। এতে বিপুল পরিমাণ সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৪১ জন। ২০১৫ সালের শুরুতেই তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে বছরের শেষ দিকে পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে আবার কিছুটা সুস্থ ধারার সূচনা লক্ষ্য করা যায়। নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য না হলেও দীর্ঘদিন পর দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির অংশগ্রহণ আগামী দিনের রাজনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিতবহ। সহিংসতার আবর্ত থেকে বেরিয়ে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার প্রসার ঘটলে অর্থনীতিসহ অন্যান্য খাতে বাংলাদেশ তার অমিত সম্ভাবনার ডানা মেলবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গত ৯ অক্টোবর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ছয়টি সমস্যার কথা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে প্রথমেই বলা হয়েছে বিনিয়োগ স্বল্পতার কথা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ে শ্লথ প্রবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তির অদক্ষতা, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ না বাড়াটাকেও সমস্যা হিসেবে দেখছেন তিনি। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তির ৭ শতাংশ ছিল নারী, এখন এটি বেড়ে ৩০ শতাংশ হলেও তা বেশ কম।
শুধু বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেছেন, যখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকংয়ের বিনিয়োগের পরিমাণ ওই সব দেশের জিডিপির ৩০ শতাংশের মতো ছিল, তখন থেকেই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছিল তারা। তাঁর মতে, বাংলাদেশও এখন এমন অবস্থায় রয়েছে। যদি বিনিয়োগ জিডিপির ৩৩-৩৪ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তবে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন খুবই সম্ভব।
বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা সবার আগে চোখে পড়ে বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাক্সের। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে যখন প্রতিবছর শীর্ষতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসছিল, তখন ২০০৭ সালের এপ্রিলে গোল্ডম্যান স্যাক্স ১১টি দেশের নামের তালিকা প্রকাশ করে, যারা (ব্রিক্স) এর পরে অগ্রগামী অর্থনীতির দেশে (নেক্সট ১১) উন্নীত হবে বলে জানায় সংস্থাটি। এই তালিকায় বাংলাদেশকেও রাখে তারা। এর আগে ২০০১ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন (ব্রিক) এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে (পাঁচ দেশের সংক্ষিপ্ত নাম ব্রিক্স) সংযোজিত করে সংস্থাটি বলেছিল, আগামী দিনে এই দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করবে। তাদের ওই পূর্বাভাস সত্য প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা আলোচনায় চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা জেপি মর্গান বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ বা প্রান্তিক দেশগুলোর মধ্যে অগ্রগামী পাঁচ দেশের একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বব্যাংকও মনে করে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনাই বাংলাদেশের রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ নেক্সট ইলেভেনভুক্ত (নেক্সট ১১) দেশগুলোর অর্থনীতি ইউরোপের ২৭ দেশের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। আর লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে ২০৫০ সাল নাগাদ।
বিশ্লেষকদের মতে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনার পেছনে কাজ করছে দেশ-বিদেশের নানা হিসাব-নিকাশ। ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক যুব শ্রমশক্তির ওপর ভর করে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের পর শিল্পশূন্য এই দেশে প্রথম প্রজন্মের হাত ধরে তৈরি পোশাক, ওষুধ, সিমেন্ট, জাহাজ নির্মাণসহ গড়ে উঠেছে বিপুল কল-কারখানা। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির ঘাত-প্রতিঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের শিল্প। বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষা-দীক্ষায় আরো দক্ষ নেতা হয়ে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বিকাশে নেতৃত্বে আসছে দ্বিতীয় প্রজন্ম। কৃষি খাতের বিকাশ, রেমিট্যান্সপ্রবাহের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান আমদানি ও রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এ অঞ্চলের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে উন্নীত করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (এপ্রিল, ২০১৫) অনুযায়ী, ২০১৬ সালে চীনের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৩ শতাংশ, ভারতের ৭.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৬.৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভারতের পরে এবং চীনের ওপরে স্থাপন করে নেবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এই বিপুল সম্ভাবনা এশিয়া ও পশ্চিমা দুনিয়ার দেশগুলোকে আকৃষ্ট করছে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক হাত গুটিয়ে নেওয়ার পরও নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতির ভেতরকার শক্তি প্রদর্শন করছে দেশগুলোর সামনে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘জাপান ও চীন বাংলাদেশকে দেখছে ভবিষ্যতের বড় বিনিয়োগের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে। ভারত বাংলাদেশকে দেখছে পারস্পরিক বিনিয়োগ, সংযোগ স্থাপন, বাণিজ্য ও সম্প্রীতির দিক থেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখছে প্রচুর সম্ভাবনাময় এবং ভবিষ্যতের লাভজনক বিনিয়োগ উেসর দেশ হিসেবে।’ বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে বড় ধরনের সুসংবাদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল।
গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ‘প্রাণোদীপ্ত বাংলাদেশ : স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনার অর্থনীতি’ পুস্তিকায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনার বড় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ অঞ্চলের বিকাশমান অর্থনীতির দেশ চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের প্রাণকেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা প্রসঙ্গে ওই পুস্তিকায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসায়িক সংযোগস্থলের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে হবে দ্রুত। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ ভারত ও চীনের জন্য বাংলাদেশের অবস্থান স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কা তাদের ব্যবসায়িক সংযোগের ভবিষ্যৎ পথ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশকে। কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে একসময় সিঙ্গাপুর দ্রুত উন্নতি করেছে। সিঙ্গাপুরের বাণিজ্যের পরিমাণ তাদের জাতীয় আয়ের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। দেরিতে হলেও ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে জল ও স্থলপথে সংযোগ স্থাপন করছে বাংলাদেশ, যার সুফল মিলবে অচিরেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে ভালো। তবে সমমানের কিছু দেশ বাংলাদেশের চেয়েও অনেকটা এগোচ্ছে। এর মধ্যে বড় দেশ চীন ও ভারতের কথা বাদ দিলেও কম্বোডিয়া, লাওস, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে ভালো করছে। ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে।’
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরো বলেন, এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২১-২২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটিকে ৩০-৩২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো যেমন জমির প্রাপ্ততা, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সুশাসন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ও অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। বর্তমানে হরতাল-অবরোধ না থাকায় রাজনীতি আপাতত স্থিতিশীল মনে হলেও ব্যবসায়ীরা মনে করছে, অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। অনেক দিন ধরে রাজনৈতিক স্বস্তি বজায় থাকবে—এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলেই বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এ কে আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য জমি চাচ্ছে। বাংলাদেশের সস্তা শ্রম ছাড়াও ইউরোপে জিএসপি সুবিধা হাতছানি দিচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। সরকারও বিনিয়োগের বাধা হিসেবে জমির সংকট মেটাতে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, যার ১৭টির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস সংকট মেটাতে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সরকার এলএনজি ও কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুৎ উত্পাদন সক্ষমতা অনুযায়ী সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। তিনি বলেন, ‘আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে বিনিয়োগের অবকাঠামোগত সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, জীবনমানের উন্নয়ন হবে সাধারণ মানুষেরও। তখন ভারতকে পেছনে ফেলে চীনের মতো বিস্ময়কর উত্থান হওয়ার সুযোগ আছে বাংলাদেশের সামনে।’