মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৬ সপ্তাহ, শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন গৃহকর্মীরা

মহিলা ও পুরুষ গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ২০ লাখেরও বেশি গৃহশ্রমিক তাদের কাজের জন্য সরকারি স্বীকৃতি পাবেন। সোমবার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

প্রত্যেক মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ, চাকরি অপসারণের ক্ষেত্রে এক মাস আগে না জানালে ৩০ দিনে মজুরী প্রদান, নারী গৃহকর্মীর মাতৃত্বকালীন সময়ে স্ববেতনে ১৬ সপ্তাহ ছুটি এবং কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণসহ শ্রম আইন অনুযায়ী সুবিধা প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে নীতিতে।

তবে, গৃহকর্মীদের সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নিয়ে কোনো কথা এই খসড়া নীতিমালায় নেই। এ ক্ষেত্রে গৃহকর্মী ও নিয়োগকর্তা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আলোচনা সাপেক্ষ্যে বেতন নির্ধারণ করবেন। একই সঙ্গে শ্রমঘণ্টার বিষয়টিও নিয়োগকর্তা এবং গৃহকর্মী আলোচনা সাপেক্ষ্যে ঠিক করবেন। নীতিমালায় সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক ছুটির কথাও উল্লেখ করা হয়নি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক এবং ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওর্য়াক’ এর সমন্বয়কারী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ এই নীতি প্রণয়ণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘এই নীতিতে বেতন, ছুটি ইত্যাদি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা না থাকলেও বিশাল সংখ্যক এই কর্মজীবী অন্তত সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটাই অনেক বড় অর্জন। এরপর আইন প্রণয়ন হলে বাকিটকু অর্জন হবে আশা করি।’

দেশে কতজন গৃহকর্মী আছেন তার কোনো হিসেব সরকারের কাছে নেই। কিন্ত, এ নীতিমালা অনুযায়ী গৃহকর্মীদের জন্য আলাদা তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলবে সরকার। গৃহশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওর্য়াক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে বাংলাদেশে ২০ লাখের বেশি গৃহশ্রমিক রয়েছেন।

নীতিতে গৃহকর্মীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘গৃহকর্মী বলতে এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝাবে যিনি নিয়োগকারীর গৃহে মৌখিক বা লিখিতভাবে খণ্ডকালীন অথবা পূর্ণকালীন নিয়োগের ভিত্তিতে গৃহকর্ম সম্পাদন করেন। এ ক্ষেত্রে মেস বা ডরমিটরিও গৃহ হিসেবে বিবেচিত হবে।’
শ্রম ও কর্ম সংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল চুন্নু বলেন, ‘গৃহকর্মী নীতিমালা সময়ের দাবি ছিল। নীতিমালাটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় ভাল লাগছে। এই সরকার দেশের সকল মানুষের কথা চিন্তা করে। এটা শুধু কথার কথা নয়, কাজ করেই আমরা প্রমাণ করছি।’

গৃহকর্মীদের সুবিধা
খসড়া নীতি অনুযায়ী, গৃহকর্মীদের জন্য শোভন কাজ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, বিশ্রাম, বিনোদন এবং ছুটির অধিকার দান, একজন শ্রমিক হিসেবে যা যা দরকার একজন গৃহকর্মীকে তার সব সুবিধা দিতে হবে নিয়োগকর্তাকে।

মহিলা গৃহকর্মীরা মাতৃত্বকালীন সময়ে প্রসবের আগে চার সপ্তাহ এবং পরে ১২ সপ্তাহ মিলিয়ে মোট ১৬ সপ্তাহ স্ববেতন ছুটি কাটাতে পারবেন। ১২ বছর বয়সীদের আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনাক্রমে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যাবে। তবে, ১৮ বছরের আগ পর্যন্ত তাদেরকে হালকা কাজের দায়িত্ব দিতে হবে।

গৃহকর্মীদের কর্মঘণ্টা বিন্যাসে পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন এবং প্রয়োজনীয় ছুটির ব্যবস্থা রাখতে হবে। অসুস্থ গৃহকর্মীকে নিয়োগকর্তা নিজের দায়িত্বে চিকিৎসা করাবেন। গৃহকর্মী ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবেন এবং কর্মক্ষেত্রে গৃহকর্মীর কোনো ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে মালিককে।

নিয়োগকর্তার দায়িত্ব
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, গৃহকর্মীর প্রতি মানবিক আচরণ করবেন। অশালীন আচরণ, দৈহিক আঘাত বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। গৃহকর্তাকে নীতিমালায় উল্লিখিত সকল সুযোগ-সুবিধা গৃহকর্মীকে প্রদান করবেন। তিনি সার্বজনীন মানবাধিকার এবং সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করবেন। প্রয়োজনীয় কাজের জন্য গৃহকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন নিয়োগকর্তা।

গৃহকর্মীর দায়িত্ব
নীতিমালায় গৃহকর্মীদের দায়িত্বের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গৃহকর্মী নিয়োগকর্তার বিশ্বাসভাজন থাকবেন। অন্যায় কাজে যুক্ত হবেন না। শিশু বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যাক্তির প্রতি যত্নশীল হবেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কর্তব্যে অবহেলা বা কোনো মালের ক্ষতি করবেন না। একই সঙ্গে, নিয়োগকর্তাকে না জানিয়ে বাড়ি ত্যাগ করবেন না।

সরকারের দায়িত্ব
গৃহকর্মীর ওপর যে কোনো ধরনের হয়রানি বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুবিচার নিশ্চিত করতে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে। গৃহকর্মীদের অধিকারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র, শ্রম এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সিটি করপোরেশনগুলোর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় বা প্রধান নির্বাহীর কার্যালয়, সেনানীবাস এলাকায় ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসারের কার্যালয় এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় এ নীতির আলোকে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করবে।

এ ছাড়া স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সকল পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কার্যালয় গৃহকর্মীদের তথ্য সংরক্ষণ এবং নীতিমালার আলোকে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণের লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করবে।

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গৃহকর্মীদের সুযোগ-সুবিধাগুলো তত্ত্বাবধান করবে। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। গৃহকর্মীরা যাতে তাদের অধিকার রক্ষায় প্রণীত হতে যাওয়া এ সব বিষয় জানতে পারেন সেজন্য সরকার সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করবে। তাদের জন্য হেল্প লাইনও চালু করবে সরকার।

নতুন এই নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে নারী অধিকার কর্মী এবং সংসদ সদস্য শিরীন আকতার বলেন, ‘নীতিমালাটির খসড়া অনুমোদন দেওয়ার জন্য সরকারকে অভিনন্দন। এমন একটি উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া দরকার ছিল। দেরিতে হলেও তা হয়েছে।’