‘হিমালয়’ জয় করেই ফিরল মেয়েরা

গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম কলসিন্দুর। যেখানে ভোর হয় ফুটবলের শব্দে। এই গ্রামের মেয়েরা ছোট ছোট টিলা বেয়ে ওপরে উঠেছে অনেকবার। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ছিল আরও উঁচুতে ওঠা। উঁচু চূড়া ছোঁয়া। সেই স্বপ্ন সত্যি হলো—এই মেয়েরা দেশে ফিরল ‘হিমালয়’ জয় করে। নেপালে গিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা জিতেছে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। কলসিন্দুরের মেয়ে মার্জিয়ার একমাত্র গোলে স্বাগতিক নেপালকে ফাইনালে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
কাল ছিল মহিলা ফুটবলে বাংলাদেশের ইতিহাস গড়ার দিন। সেই ইতিহাসের অংশ শুধু ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত কলসিন্দুরের ১০ ফুটবলারই নয়, তাদের সঙ্গী টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা, রুমা, জোছনা ও মৌসুমী; রাজশাহীর নার্গিস; সাতক্ষীরার রাজিয়া; রাঙামাটির মনিকা ও রংপুরের স্বপ্নাও। মেয়েদের জাতীয় বা বয়সভিত্তিক কোনো দলের প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য এটি। একাদশে কাল খেলেছে কলসিন্দুরের ছয় ফুটবলার—সানজিদা, শিউলি, শামসুন্নাহার, মারিয়া, মার্জিয়া ও তসলিমা। ডাগআউটে আরও ছিল মাহমুদা, রূপা, তহুরা ও নাজমা।
ফাইনালটি হওয়ার কথা ছিল গত ২৫ এপ্রিল। প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের কারণে ফাইনালটি স্থগিত করে এএফসি (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন)। পূর্বনির্ধারিত সেই ফাইনাল হয়েছে কাল।
গ্রুপ পর্বে দাপটের সঙ্গে খেলা বাংলাদেশ ফাইনালেও ধরে রেখেছে সেই ধারাবাহিকতা। ৭০ মিনিটের ম্যাচ। ১৬ মিনিটেই গোলের দেখা পায় বাংলাদেশ। বাঁ প্রান্ত থেকে স্ট্রাইকার মার্জিয়ার প্রায় ৩৫ গজ দূরের লক্ষ্যভেদী শট নেপালের গোলরক্ষক রবিতা কুমারীর মাথার ওপর দিয়ে ঢুকে যায় জালে। হতভম্ব রবিতাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হলো তা। ১০ নম্বর জার্সি গায়ের মার্জিয়া গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোতেও ছিল অপ্রতিরোধ্য, ৩ ম্যাচে করেছিল ৪ গোল। কাল এল সবচেয়ে মূল্যবান গোলটি।
৩৪ মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগ এসেছিল অধিনায়ক কৃষ্ণার সামনে। কিন্তু গোলরক্ষককে একা পেয়েও বাইরে মারায় নষ্ট হলো সেই সুযোগ। দ্বিতীয়ার্ধে আরও উজ্জ্বল ছিল বাংলাদেশ। নেপালের রক্ষণে বারবার ঢুকে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সানজিদারা। যদিও একাধিক সুযোগ নষ্ট করায় আর গোল আসেনি। বাংলাদেশ কর্নার আদায় করেছে ১৪টি। তবে তা থেকে একটি গোলও করতে পারেনি। সেটি অবশ্য আর আফসোসের কারণ হয়ে থাকেনি।
শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন মাঠে নিয়ে এলেন জাতীয় পতাকা। ডাগআউট থেকে ছুটে গেলেন সাইড লাইনের খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তারা। খেলা দেখতে মাঠে আসা নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারাও উৎসবে মেতে ওঠেন। মুহূর্তেই কাঠমান্ডুর সেনাবাহিনী শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র মাঠটা হয়ে ওঠে এক টুকরো বাংলাদেশ। সানজিদা-মারিয়া-কৃষ্ণাদের ঘিরে শুরু হয় আনন্দনৃত্য।
সোনার পদক নিয়ে কালই দেশে ফিরেছে চ্যাম্পিয়ন দলটি। সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে ফুটবলারদের সংবর্ধনা দিয়েছেন বাফুফে কর্মকর্তারা। মিষ্টিমুখ করিয়েছেন খেলোয়াড়দের। উচ্ছ্বসিত কোচ গোলাম রব্বানী বিমানবন্দর থেকেই মুঠোফোনে বললেন, ‘কী যে ভালো লাগছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। অনেক কষ্টের পর মহিলা ফুটবল দল কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো।’ পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের দায়িত্বে আছেন। এত দিন কোনো সাফল্য না পেলেও এবারের টুর্নামেন্টে জয়ের ব্যাপারে আগে থেকেই ছিলেন আশাবাদী। কিন্তু খেলার মাঠের পারফরম্যান্সে কোচের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে মেয়েরা, ‘নেপালের সঙ্গে আগেও খেলেছে বাংলাদেশ, তখন দুই দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আমি তাই আশা করিনি, এতটা একচেটিয়া খেলবে মেয়েরা। দুর্ভাগ্য যে, আমরা ৪-৫ গোলে জিতিনি।’
মার্জিয়ার কণ্ঠেও খুশির ঢেউ, ‘চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে খুব খুশি। খেলা শুরুর আগে সবাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমাদের জিততেই হবে।’ গোল করার অনুভূতিটা বলার সময় কেঁপে যাচ্ছিল তার কণ্ঠ, ‘স্যার আমাকে বলে দিয়েছিলেন, বারের আশপাশে বল পেলেই শট করবি। আমি শট করেছি, এরপর দেখি, বল জালে!’ কলসিন্দুরের মার্জিয়াদের নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র অদম্য মেয়েরা তাদের পরিচিত করেছে বৃহত্তর দুনিয়ার সঙ্গে। গত ৬ নভেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কলসিন্দুর গ্রামের ২০ জন মেয়ে ফুটবলারকে (অনূর্ধ্ব-১৪) সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
মাস দুয়েক আগে চীনে এএফসির সভায় এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠা দুই দলকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করার চিন্তাভাবনা হয়েছিল। কিন্তু এএফসির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার সেদিন আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘কারোর দয়ায় নয়, আমাদের মেয়েরা খেলেই শিরোপা নিয়ে আসবে।’
খেলেই শিরোপা নিয়ে এল কৃষ্ণা-সানজিদা-মার্জিয়ারা।
বাংলাদেশ দল: শামসুন্নাহার, রুমা, শিউলি, নার্গিস, সানজিদা, মৌসুমী, কৃষ্ণা, মার্জিয়া, স্বপ্না, মারিয়া, তাসলিমা।