বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯২ সালে। তখন রাজধানীতে পথে যানজট ছিল না। দীর্ঘ বিরতির পর গত শনিবার তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন। এবার তিনি রাত ১০টায়ও যানজট পান। তাঁর মতে, রাস্তায় অনেক গাড়ি চলছে, এটা অর্থনৈতিক সক্ষমতারই একটি বার্তা। আর এই যানজট অর্থনীতির নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। উন্নয়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত লোকবক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নকে এভাবেই তুলে ধরেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সালে মাথাপিছু আয়, জিডিপির অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি খাতের অগ্রগতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন।
প্রথিতযশা এই বাঙালি অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি হবেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৯ শতাংশের সমপরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে। এটা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সংকেত।
কৌশিক বসুর পূর্বাভাস হচ্ছে, এ বছর বাংলাদেশ সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। আগামী বছর তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে, যা চীনের সমান। এ তুলনা ৫-১০ বছর আগে চিন্তা করাও দুরূহ ছিল। তিনি বলেন, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ লোকবক্তৃতার বিষয়বস্তু ‘বিশ্ব অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা: সমস্যা ও সম্ভাবনা’। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিরা লোকবক্তৃতা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল কৌশিক বসুর জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে কৌশিক বসু সোজাসাপটা জবাব দেন, ‘হ্যাঁ’। আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, নিজেদের ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্জনের পথটা শুরু হয়েছিল যখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকংয়ের বিনিয়োগের পরিমাণ ওই দেশের জিডিপির ৩০ শতাংশের মতো ছিল। বাংলাদেশও এখন এমন অবস্থায় রয়েছে। যদি বিনিয়োগ ৩৩-৩৪ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তবে ৮ প্রবৃদ্ধি অর্জন খুবই সম্ভব।
তবে কৌশিক বসুর মতে, শুধু অর্থনৈতিক নীতি দিয়ে প্রবৃদ্ধি হয় না। মানুষের মনের ভেতরেই প্রবৃদ্ধির আসল শক্তিটা রয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শিক্ষা খাতে উন্নয়ন করতে হবে। এতে উদ্যোক্তা তৈরি হবে।
কৌশিক বসু বলেন, বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যা বোনাসের যুগে প্রবেশ করেছে। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে প্রবেশ করবেন। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাঁদের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ জনসংখ্যা বোনাসের সুযোগ নিতে এর ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
দারিদ্র্য বিমোচন, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যু হ্রাসসহ বাংলাদেশের সামাজিক খাতের অগ্রগতির প্রশংসা করে কৌশিক বসু বলেন, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভারতের জনগণের মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়েছে। কিন্তু সামাজিক খাতে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এই সামাজিক খাতের অগ্রগতিতে ভারতের চেয়ে পরিষ্কার এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই অর্জনকে তিনি ‘রিমার্কেবল’ হিসেবে দেখছেন।
অর্থনীতির এমন সম্ভাবনার মধ্যে বাংলাদেশের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন কৌশিক বসু। এর মধ্যে একটি হলো অবকাঠামো দুর্বলতা, অপরটি কার্যকর নীতির অভাব। তিনি বলেন, অবকাঠামো দুর্বলতা দূর করতে কার্যকর বন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ব্যবসায় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। আর দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ হয়, এমন নকশা করেই নীতি তৈরি করতে হবে। এ নীতির সুফল পাবেন যাঁরা, তাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও সক্ষমতা বিবেচনায় আনতে হবে।
বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এসব কোম্পানি মুনাফা করার জন্য আসে, এটাই স্বাভাবিক। দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিটি এমনভাবে করতে হবে, যেন বহজাতিক কোম্পানিও ‘মেগা’ মুনাফা করে, আবার দেশও ‘মেগা’ মুনাফা পায়। এ ধরনের চুক্তি করার মতো মেধাসম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে। আবার বেশি দর-কষাকষি করলে বিনিয়োগকারীরা চলে যেতে পারেন। তাই একটি ভারসাম্য রেখে দর-কষাকষি করতে হবে।
তবে তিনি এ-ও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি বিনিয়োগকে এ দেশে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এ দেশে আসে, তখন সেটা ছিল পুরোপুরি বিদেশি বিনিয়োগ। ঔপনিবেশিক ধারণা থেকে এখনো আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি।
ধনী-গরিবের বৈষম্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের মত হলো, এ বৈষম্য শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবিত্তের আয় কমে যাওয়ায় সেখানেও বৈষম্য বাড়ছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে কর-ব্যবস্থা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বড়লোকের কাছ থেকে কর নিয়ে তা গরিবের কল্যাণে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য) খরচ করতে হবে।
বিশ্বায়ন সম্পর্কে কৌশিক বসু বলেন, বিশ্বায়নকে কেউ পছন্দ করতে পারেন, আবার কেউ না-ও করতে পারেন। কিন্তু এটাই এখন বাস্তবতা। বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের মতো দেশ বিশ্বায়ন থেকে সুবিধা পাচ্ছে। আবার কোনো কোনো দেশ অসুবিধায়ও পড়ছে। কিন্তু বিশ্বায়ন এখন জীবনের অংশ। অর্থনৈতিক উদারীকরণের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশ অনেক বেশি সম্পৃক্ত। তাই বিশ্ব অর্থনীতি আক্রান্ত হলে বাংলাদেশও আক্রান্ত হতে পারে।
এই অঞ্চলের জ্বালানি নিরাপত্তায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন তিনি। নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ যেন ভারত ও বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে, এ জন্য সহযোগিতার তাগিদ দেন তিনি।