বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক আস্থা কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশের। এমনকি এ তালিকায় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির ২৪ দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানটি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসির সর্বশেষ বাণিজ্য পূর্বাভাস ও জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্বের ছয় হাজার ৩০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত এ জরিপে আগামী ছয় মাস বিশ্ববাণিজ্য কোনদিকে যাবে সেই মূল্যায়ন করা হয়।
এতে দেখা যায়, আগামী ছয় মাসের জন্য বৈশ্বিক বাণিজ্যিক আস্থা ১২০ পয়েন্টে নেমে এলেও বাংলাদেশের ২৩ পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে ১৩১ পয়েন্ট। এর মধ্য দিয়ে ২৫ দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আস্থা জরিপে (টিসিএস) শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ১২৯ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত, একই পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। ১২৮ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং একই পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম মিসর। এ তালিকায় ১২৬ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ১২০ পয়েন্ট নিয়ে দশম অবস্থানে রয়েছে জার্মানি।
এইচএসবিসির জরিপে বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোতে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকের চাহিদার কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক আস্থা ঊর্ধ্বমুখী। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের আরো সাতটি রপ্তানি খাতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনের জানান দিচ্ছে। এ সবকিছু মিলেয়েই শীর্ষে বাংলাদেশ। সংস্থার মতে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস দুর্বল হলেও বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা ভালো।
জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা জানান, আগামী ছয় মাসে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়বে আগের ছয় মাসের তুলনায়। এ ছাড়া অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা মনে করেন আগামী ছয় মাসের জন্য বাণিজ্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অঞ্চল থাকবে এশিয়া। এ ছাড়া ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন বাণিজ্যির জন্য গত ছয় মাসের চেয়েও বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে ইউরোপ। আর এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার ইউরোপ। এইচএসবিসির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এসেছে ৭ শতাংশ। সংস্থা আশা করছে, ২০১৫ সালের পুরো বছরের হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ এবং ২০১৬ সালেও একই থাকবে। সংস্থা জানায়, প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি এবং পরিবহন ও জ্বালানি অবকাঠামোয় বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক আস্থা বাড়ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি এবং অব্যাহত বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের বাণিজ্যে সুসংহত গতি আসবে। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে অবকাঠামো উন্নয়ন, যার অন্যতম উদাহরণ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি উদ্যোগ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেশ কিছু বড় প্রকল্প এখনো নির্মীয়মান রয়েছেÑযেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক এবং পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প ও এলএনজি টার্মিনাল। এ ছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাকশিল্পে বাংলাদেশে চীনের চেয়ে কম মজুরিতে উৎপাদন করতে পারায় সম্ভাবনা বাড়ছে এ খাতে। বিশেষ করে ক্রেতা সংগঠনগুলোর পোশাক কারখানা পরিদর্শনের ফলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মান উন্নত হচ্ছে ও ইমেজও ফিরে পাচ্ছে। দেশটিতে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স অগ্নিকাণ্ড এবং ভবন নিরাপত্তা মান নিশ্চিতে অনেক দূর এগিয়েছে। যদিও মজুরি বৃদ্ধিতে কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে পড়বে পোশাকশিল্প। তবে পোশাকশিল্পের সম্ভাবনা দিয়েই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক। আশা করা যায়, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে তিন-চতুর্থাংশ অবদানই রাখবে এ খাত। এর পাশাপাশি টেক্সটাইল এবং কাঠশিল্পও ১৫ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আসবে এ সময়। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে শিল্প যন্ত্রাংশ রপ্তানির দিকে যাচ্ছে। এ খাত থেকেও ১২ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আসবে ২০২১-৩০ সাল নাগাদ। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাণিজ্যের আরো নতুন দিক উন্মোচন করছে। আশা করা যায়, আইসিটি সরঞ্জামাদি রপ্তানিতে ২০২১-৩০ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি আসবে ১৩ শতাংশ। সড়ক যান এবং পরিবহন সরঞ্জামাদি রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আসবে ১৪ শতাংশ।
এইচএসবিসির তালিকায় একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তিনটি রপ্তানি বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। এ দেশগুলো ২০৩০ সাল পর্যন্তই বাংলাদেশের শীর্ষ তিন রপ্তানি বাজার হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানিবাজার হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ফ্রান্স আর পঞ্চম কানাডা। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কিছুটা কমলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ দেশটিই থাকবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৫ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তবে সম্মিলিত বাজার হিসেবে ইউরোজোনেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। অন্যদিকে আমদানি খাতে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটায় আশা করা যায় ২০২১-৩০ সাল পর্যন্ত শিল্প যন্ত্রাংশ বাংলাদেশের আমদানি প্রবৃদ্ধিতে ২০ শতাংশ অবদান রাখবে। এর পাশাপাশি পরিবহন সরঞ্জামাদি আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। তবে টেক্সটাইল এবং কাঠশিল্প বাংলাদেশের আমদানিতে সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে বিবেচিত হবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানি বাজার যথাক্রমে চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও হংকং। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রধান পাঁচটি আমদানি বাজার থাকবে চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া।
সংস্থার মতে, যদিও বাংলাদেশে রপ্তানির ৮০ শতাংশই পূরণ করছে টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক। তবে ভবিষ্যৎ শুধু এ খাতের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। ২০১৬-২০ সাল পর্যন্ত আটটি রপ্তানি খাতের সাতটিতেই দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি আসবে। শুধু কৃষি খাতে রপ্তানি কিছুটা শ্লথ থাকবে।