টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষি

বাংলাদেশ ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস ও দুধ উৎপাদনে যে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার মূল নায়ক হলো কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী ও মাঠপর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীরা। এ অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বিত ও গতিশীল করতে হলে কৃষি গবেষণা কাজে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তারা অধিক অর্থ লাভের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি না জমান।- নিতাই চন্দ্র রায়: কলাম লেখক

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে আরো অনেক দূর এগোতে হবে। পাড়ি দিতে হবে পিচ্ছিল পথ। এশীয় অঞ্চলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে নেপাল ও ভুটান। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের হিসেবে বাংলাদেশেরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তবে মানব সম্পদ সূচকের সামান্য উন্নতি করতে পারলে এলডিসি থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারবে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশই কৃষি খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে পারেনি। তাই আমাদের পক্ষেও কৃষিতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ছাড়া এলডিসির তালিকা থেকে বের হওয়া ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে পেঁৗছানো সম্ভব হবে না। এ জন্য গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কৃষি পণ্যের যথাযথ বাজারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’ সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আঙ্কটাডের এলডিসি রিপোর্ট-২০১৫ উপস্থাপন উপলক্ষে সিপিডি আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। এ বছর প্রতিবেদনে গ্রামীণ অর্থনীতি রূপান্তরের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নেপাল ও ভুটান ইতোমধ্যে অনেক এগিয়ে গেছে। আগামী ছয় বছর তারা পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকবে। আর আমাদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে এ বিবেচনার মধ্যে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে আমাদের এলডিসি থেকে বের হতে হলে উত্তরণকালীন পকিল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যেন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করে গ্রাম পর্যায়ে উন্নয়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কৃষি খাতের উন্নয়নে কৃষিপণ্য গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসা সহজ করতে হবে। কৃষিপণ্য রপ্তানি সহজ করতে হবে। কৃষির সঙ্গে শিল্পের সংযুক্তি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পকিল্পনায় মানব সম্পদ উন্নয়নের পদক্ষেপ থাকলেও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পেঁৗছে যাবে বলে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যা বলছেন, তা পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে পেঁৗছে গেছে। মধ্যমধ্যম আয়ের দেশ বলে কোনো শ্রেণি বিভাগ নেই। আর উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পেঁৗছতে হলে আমাদের মাথাপিছু আয় অন্তত চারগুণ বাড়িয়ে ৪ হাজার ১২৫ ডলার করতে হবে, যা এই সময়ের মধ্যে অবাস্তব। কেউ কেউ বলেন, এলডিসির তালিকা থেকে বের হতে হলে আয় বৃদ্ধির সূচক, মানবোন্নয়ন সূচক এবং ভঙ্গুরতা সূচকের যে কোনো দুটি সূচকে লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। আয় সূচকের ক্ষেত্রে তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে গড় আয় হতে হবে ১ হাজার ২৪২ ডলার, যা বর্তমানে আছে ৯২৬ ডলার। মানবোন্নয়ন সূচক হতে হবে ৬৬ পয়েন্টের বেশি। যেখানে বর্তমানে আছে ৬৩ দশমিক ৮ পয়েন্ট। শুধু ভঙ্গুরতা সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। সুতরাং এলডিসি থেকে বের হতে হলে মানবোন্নয়নে নজর বাড়াতে হবে। তবে ২০১৮ সালের মধ্যে দুটি সূচকে লক্ষ্য অর্জন করতে পারলেও এরপর দুই দফায় তিন বছর করে ৬ বছরে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা বা ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। কিন্তু জমি ও জনশক্তির হিসেবে আবার সর্বনিম্ন অবস্থানে। শিল্পে কর্মসংস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। প্রকৃত অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের দিক থেকে ৪৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। প্রকৃত দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।
তাই এলডিসি থেকে বের হতে হলে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়ন করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে মানসম্পন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। কৃষি গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে। কৃষির জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কৃষি পণ্যের বাণিজ্যিক সুুবিধা বাড়াতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি একটি অলাভজনক পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারে না। এ বছর প্রতি মণ বোরো ও আমন ধানে কৃষককে ২০০ টাকা করে লোকসান গণতে হয়েছে। শাক-সবজি, পেঁয়াজ, আলু, মরিচ, হলুদের ভালো মূল্য পেলেও তার পরিমাণ সীমিত। এসব পণ্যের দাম সব সময় সমান থাকে না। মৌসুমের শুরুতে বেশি হলেও ভরা মৌসুমে এসব পণ্য পানির দামে বিক্রি করতে হয় কৃষককে। গত বছর ভরা মৌসুমে ৭ থেকে ৮ টাকা কেজি দরে কৃষক আলু বিক্রি করেন। এখন ব্যবসায়ীরা সেই আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করে বিক্রি করছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজিতে। কজন কৃষকের আলু এখন হিমাগারে সংরক্ষিত আছে? এছাড়া কৃষি উন্নয়নের বড় বাধা হলো কৃষি শ্রমিকের অভাব। গত ৩-৪ বছরে কৃষি শ্রমিকের মজুরি যেভাবে বেড়েছে কৃষিপণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। এছাড়া কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের অভাবে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশে মাত্র শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। অথচ থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর কৃষি উন্নত দেশগুলোতে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এতে মূল্য সংযোগ বেশি হয় এবং কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের অধিক মূল্য পান। বাংলাদেশে কয়েকটি চিনিকল ও পাটকল ছাড়া তেমন কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা নেই। এটাও কৃষি পণ্যে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আর একটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হলে কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে গুণগত মানের পরিচ্ছন্ন বীজের ব্যবহার। পরিচ্ছন্ন বীজের ব্যবহারের শস্যের ফলন শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ বাড়ানো যায়। দেশে গুণগত মানের বীজের চাহিদা রয়েছে বছরে ১১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু আলু বীজের চাহিদা ৬ লাখ টন, ধান বীজের চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টন এবং শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসলের বীজের চাহিদা দেড় লাখ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন মাত্র দেড় লাখ টন বীজ সরবরাহ করে। বাকি বীজ কৃষক বেসরকারি কোম্পানি ও নিজস্ব উৎপাদন থেকে ব্যবহার করেন, যার গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কৃষি শ্রমিকের সমস্যা সমাধানে আমাদের শস্য বিন্যাস, মাটি, আবহাওয়া, ভূমির আয়তন এবং কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে দেশীয় কারখানায় স্থানীয়ভাবে ব্যবহার উপযোগী কৃষি যন্ত্র তৈরি করতে হবে। এজন্য এখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং শিল্পপতিদের এগিয়ে আসতে হবে। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য পান সেজন্য বাজার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে কৃষিবাজার তৈরি করতে হবে, যেখানে কৃষক কোনো মধ্যস্বত্ব্বভোগীর সহায়তা ছাড়াই সরাসরি ভোক্তার কাছে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারে। বিদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। এজন্য আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুসারে গুণগতমানের কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে হবে, প্যাকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। চুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষিত চাষিদের মাধ্যমে রপ্তানি উপযোগী পণ্য নির্বাচিত স্থানে উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণের জন্য কৃষক প্রশিক্ষণ, ফলাফল ও পদ্ধতি প্রদর্শনী সভা এবং মাঠ দিবসসহ কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম আরো জোরদার ও বেগবান করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষিবিষয়ক কর্মকা- সম্প্রচারের জন্য সরকারিভাবে আলাদা টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন করতে হবে। ভিয়েতনামের মতো কৃষকের সঙ্গে কৃষি বিজ্ঞানীদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কৃষকের সমস্যা সমাধানে ই-কৃষি সেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো উন্নয়নই টেকসই হয় না। তাই কৃষি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে নদী-নালা, খাল-বিল ও বৃষ্টির পানি ব্যবহারের দিকে বেশি নজর দিতে হবে বেশি।
বাংলাদেশ ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস ও দুধ উৎপাদনে যে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার মূল নায়ক হলো কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী ও মাঠপর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীরা। এ অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বিত ও গতিশীল করতে হলে কৃষি গবেষণা কাজে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তারা অধিক অর্থ লাভের জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি না জমান।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। যত দিন যাচ্ছে নগরবাসির সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষকে কৃষি কাজের বাইরে রেখে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা কোনোমতেই সম্ভব হবে না। তাই গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নগরে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরীয় কৃষিব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে।